অ্যান্টিভেনম কি এবং এটি কীভাবে তৈরি করা হয়

প্রতি বছর, বিশ্বজুড়ে প্রায় ১00,000 মানুষ, বিষধর সাপের কামড়ের কারণে মারা যায় । বিষের বিষাক্ততা এবং কতটা বিষ শরীরে প্রবেশ করেছে তার উপর নির্ভর করে, বিভিন্ন ধরনের লক্ষন দেখা যায়, যেমন – পেশী দুর্বলতা, বমি বমি ভাব, গিলতে সমস্যা, অতিরিক্ত লালা এবং মারাত্মক শ্বাসকষ্ট । মৃত্যু এড়াতে, সাপের কামড়ানো ব্যাক্তিকে, চিকিৎসার জন্য দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে । যদি রোগীকে যথাসময়ে হসপিটালে নেওয়া যায় এবং সেই হাসপাতালে যদি সংশ্লিষ্ট সাপের বিষের অ্যান্টিভেনম থাকে – তাহলে আক্রান্ত ব্যক্তির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রায় ১০০% । আপনারা জেনে অবাক হবেন যে, বিষধর সাপের কামড়ে এত লোক মারা যাওয়ার অন্যতম কারণ হল, হাসপাতালে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম না থাকা । আজকের আর্টিকেলে আমরা আপনাদের সাথে, অ্যান্টিভেনম কি এবং এটি কীভাবে তৈরি করা হয়, ইত্যাদি বিষয় নিতে বিস্তারিত আলোচনা করব ।

অ্যান্টিভেনম কি – অ্যান্টিভেনম কাকে বলে

অ্যান্টিভেনম শব্দটি, অ্যান্টি এবং ভেনাম এই দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত । অ্যান্টি শব্দের অর্থ হল বিরুদ্ধে এনং ভেনম শব্দের অর্থ হল বিষ । অর্থাৎ অ্যান্টিভেনাম শব্দের পূর্ণ অর্থ হল, বিষের বিরুদ্ধে । বিষের বিরুদ্ধে কার্যকর বা বিষ নিষ্ক্রিয় করতে পারে এমন উপাদানকে অ্যান্টিভেনাম বা এন্টিভেনিন বলা হয় ।

অ্যান্টিভেনম ( “অ্যান্টিভেনিন”) হল এক ধরনের অ্যান্টিবডি পণ্য, যা একটি নির্দিষ্ট বিষের টক্সিন নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম । সাপের কামড় বা দংশনের পরে, দ্রুত অ্যান্টিভেনাম ইনজেকশন দিলে, অ্যান্টিভেনমের অ্যান্টিবডিগুলি বিষকে নিষ্ক্রিয় করে । যার ফলে আক্রান্ত ব্যাক্তির জীবন বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বেঁচে যায় ।

অ্যান্টিভেনাম, সাপের বিষ ধ্বংস করার পাশাপাশি, অন্যান্য বিষাক্ত প্রাণির বিষ ( যেমন- ব্লাক উইডো মাকড়শা, জেলিফিশ, মাছ, ব্যাঙ ইত্যাদির বিষ ) ধ্বংস করতেও ব্যবহৃত হয় ।

অ্যান্টিভেনম এখনও একই পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়, যা ১৮৯০-এর দশকে ডিপথেরিয়া এবং টিটেনাসের জন্য অ্যান্টিটক্সিন তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল । একটি প্রাণী, যেমন একটি ঘোড়া বা ছাগলের শরীরে, অল্প পরিমাণ বিষ, ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হয় । ক্ষতিকারক বিষের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য, সেই প্রাণীর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অ্যান্টিবডি তৈরী করে । পরবর্তীতে সেই অ্যান্টিবডিগুলি, প্রানির শরীরের রক্তের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয় । এরপর সেই সংগৃহীত রক্তের, সিরাম বা প্লাজমাকে ঘনীভূত করে কিছু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অ্যান্টিভেনম তৈরী করা হয় ।

অ্যান্টিভেনম শরীরে বিষের কারণে হওয়া ক্ষতি প্রতিরোধ করতে সক্ষম । সুতরাং, সাপে কামড়ানোর পরে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অ্যান্টিভেনম চিকিৎসা শুরু করা উচিত । বিষের পরিমাণ এবং বিষাক্ততার উপর ভিত্তি করে, সাপে কামড়ানো ব্যক্তির উপর পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টিভেনম, ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয় । বিষের মাত্রা বেশী হলে অনেকগুলি অ্যান্টিভেনম ইঞ্জেকশনের প্রয়োজন হতে পারে । অ্যান্টিভেনমগুলো সাধারণত একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির বিষের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তৈরি করা হয় । 

অ্যান্টিভেনিন কে আবিষ্কার করেন – অ্যান্টিভেনামের আবিস্কারক কে

১৮৯৬ সালে ফ্রান্সের বিজ্ঞানী আলবার্ট ক্যালমেট সর্বপ্রথম এন্টিভেনাম আবিষ্কার করেন ।

এন্টিভেনাম এর প্রকারভেদ – অ্যান্টিভেনাম কত প্রকার

কার্যকরিতার উপর ভিত্তি করে এন্টিভেনামকে ২ ভাগে ভাগ করা যায় ।

মনোভ্যালেন্ট এন্টিভেনাম – যে এন্টিভেনমগুলো শুধু একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির সাপের বিষের বিরুদ্ধে কার্যকর, সেগুলোকে মনোভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনাম বলা হয় ।

পলিভ্যালেন্ট এন্টিভেনাম – যে অ্যান্টিভেনামগুলো একাধিক প্রজাতির সাপের বিষের বিরুদ্ধে কার্যকর, সেগুলোকে পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনাম বলে ।

অ্যান্টিভেনম তৈরির ইতিহাস

অ্যান্টিভেনম তৈরির ইতিহাস জানতে হলে আপনাকে ১৮৯০ সালে ফিরে যেতে হবে । তখন ভিয়েতনাম ছিল ফ্রান্সের একটি উপনিবেশ । সেই সময় আলবার্ট ক্যালমেট ছিলেন পাস্তুর ইন্সটিটিউট এর একজন ছাত্র । তখন বর্ষাকালে নিচু এলাকা প্লাবিত হলে, গোখরা সাপের উপদ্রব খুব বেড়ে যেত এবং প্রতিদিন অনেক মানুষ সাপের কামড়ে মারা যেত ।

এমনই এক বন্যার পরে ভিয়েতনামের একটি গ্রামে একটি গোখরা সাপের কামড়ে প্রায় ৪০ জনে মানুষের মৃত্যু হয় । এই ঘটনার পর ক্যালমেট, সাপের বিষের প্রতিষেধক আবিষ্কারের দিকে মনোনিবেশ করলেন । ক্যালমেট দেখলেন যে, গাধা এবং ঘোড়াকে সাপে কামড় দিলে, গাধা বা ঘোড়ার তেমন কিছু হয় না । আর এই আশ্চর্য বিষয় থেকেই তিনি তার প্রতিষেধক আবিস্কারের কাজ শুরু করেন ।

আর এই বিষয় নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করার পর তিনি জানতে পারলেন যে, ঘোড়া এবং গাধার দেহে প্রাকৃতিকভাবে সাপের বিষের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করার জন্য, হাইপার ইমিউনিটি পাওয়ার উপস্থিত থাকে । এই ইমিউনিটি পাওয়ারের কারণে, গাধা এবং ঘোড়ার দেহে সাপের বিষ ধ্বংস করার জন্য প্রচুর পরিমাণে এন্টিবডি তৈরী হয় । আর এই কারনেই সাপের কামড়ে গাধা ও ঘোড়া মরে না । ক্যালমেট প্রথমে গোখরা সাপ কামড় দেয়া গাধার রক্ত থেকে এন্টিবডি কালেক্ট করলেন । তারপর সেই সংগৃহীত এন্টিবডি সাপেকাটা ব্যাক্তির শরীরে প্রবেশ করালেন এবং সাপেকাটা ব্যক্তি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠলো । পরবর্তীতে সাপ কামড় দেয়া ঘোড়ার রক্ত কালেক্ট করে, একইভাবে ব্যবহার করে আশানুরূপ ফলাফল পেলেন ।

আর এভাবেই ১৮৯৬ সালে, ফরাসি বিজ্ঞানী আলবার্ট ক্যালমেট সর্বপ্রথম অ্যান্টিভেনম তৈরি করেছিলেন (কোবরা বিষের বিরুদ্ধে) । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অ্যান্টিভেনম তৈরি হতে আরও ৩০ বছর সময় লেগেছিল । ফিলাডেলফিয়ার এইচকে মুলফোর্ড কোম্পানি, ১৯২৭ সালে বিজ্ঞাপন দেয় যে, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অ্যান্টিভেনম উৎপাদন ও বিক্রি করার জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রথম কোম্পানি । এই কোম্পানি, অ্যান্টিভেনমের ব্রাজিলিয়ান ডেভেলপার, আমেরিকার অ্যান্টিভেনিন ইনস্টিটিউটের ডক্টর আফ্রিয়ানো ডো আমরালের সাথে পার্টনারশিপ করেছিল । ডাঃ অমরাল, ইনস্টিটিউটের সাপ থেকে বিষ কালেক্ট করা ও পরিশোধনের তত্ত্বাবধান করতেন । তারপর সেই বিষ, মুলফোর্ড ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হত । সেখানে অ্যান্টিভেনম তৈরি করার জন্য, কোম্পানির ঘোড়াগুলিতে ইনজেকশনের মাধ্যমে সেই বিষ প্রয়োগ করা হত ।

মুলফোর্ডের অ্যান্টিভেনিন

১৯২৭ সালে, মুলফোর্ড কোম্পানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অ্যান্টিভেনম উৎপাদন এবং বিক্রি করার প্রথম লাইসেন্স প্রাপ্ত কোম্পানি হওয়ার গৌরব অর্জন করে । The Journal of the Florida Medical Association, Inc., আগস্ট 1927, Vol. XIV, নং 2

মুলফোর্ডের তৈরী প্রাথমিক অ্যান্টিভেনম প্রোডাক্ট হল Antivenin Nearctic Crotalidae । এই অ্যান্টিভেনমটি পলিভ্যালেন্ট ছিল । যার অর্থ হল, এই অ্যান্টিভেনামে থাকা অ্যান্টিবডি, একাধিক প্রজাতির ভাইপার সাপের বিষের বিরুদ্ধে কার্যকর ছিল । এর মধ্যে ছিল, উত্তর আমেরিকার পিট ভাইপার, র‍্যাটলস্নেক, মোকাসিন এবং কপারহেড । ১৯২৯ সালে, নতুন সিরাম থেরাপির একটি প্রদর্শনীর অংশ হিসাবে জাদুঘরটি মুলফোর্ড কোম্পানি থেকে Antivenin Nearctic Crotalidae একটি নমুনা কালেক্ট করে ।

১৯২৭ সালেই, জাতীয় মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের জার্নাল, মুলফোর্ডের উত্তর আমেরিকার পিট ভাইপার অ্যান্টিভেনমের প্রবর্তন উদযাপন অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেন যে, “প্রতিটি ফাস্ট এইড কিট বক্সে অ্যান্টিভেনিনের একটি প্যাকেজ অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ।” মুলফোর্ড কোম্পানি দাবি করেছিল যে, সাপের কামড়ের ঝুঁকিতে থাকা সকল মানুষের জন্য একটি অ্যান্টিভেনম বীমা করা প্রয়োজন এবং সেই সাথে সতর্ক করেছিলেন যে, শিশু, জেলে, শিকারী, কৃষক, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এবং ইউটিলিটি কর্মী সকলেই সাপের কামড়ের সম্ভাব্য প্রার্থী । সংস্থাটি আরও বলেছে যে, সামরিক শিবির এবং নির্মাণ সাইটগুলির সকলেরই দায়িত্ব ছিল অ্যান্টিভেনম হাতে রাখা । তখনকার সময়ে অ্যান্টিভেনম ছিল একদম নতুন প্রযুক্তি, যা সাধারণ মানুষের ভয়ের সামনে আশার আলো জাগিয়েছিল । ১৯৩০ সালে, এই জাদুঘরটি পুনরায় মুলফোর্ড কোম্পানির কাছ থেকে, “সাপের কামড়-বিরোধী সিরাম” তৈরি এবং ব্যবহারের চিত্র, প্রদর্শনের জন্য কালেক্ট করে ।

এই সময়ের মধ্যে, এইচকে মুলফোর্ড কোম্পানি, আরও দুটি নতুন জাতের সাপের অ্যান্টিভেনম অফার করেছিল । এর মধ্যে একটি হল, অ্যান্টিভেনিন বোথ্রপিক এবং আরেকটি হল পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম অ্যান্টিভেনিন বোথ্রপিক, বোথ্রপস গোত্রের দক্ষিণ আমেরিকার পিট ভাইপার সাপের বিষকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল । আমেরিকায়, অন্য যে কোনও সাপের তুলনায়, এই সাপের কামড়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয় । 

মুলফোর্ড তার, অ্যান্টিভেনিন বোথ্রপিক অ্যান্টিভেনম আগে থেকে ভর্তি একটি সিরিঞ্জের কিটে সরবরাহ করেছিল । এর ফলে এটি খুব সহজে পরিবহন এবং পরিচালনা করা যেত । সেই সাথে চিকিৎসাও দ্রুত করা যেত । কিটের নির্দেশনা অনুসারে, সাপের কামড়ানোর সাথে সাথে, আপনাকে যত দ্রুত সম্ভব, আপনার উরু বা পেটের ত্বকের নীচে সিরিঞ্জে থাকা সম্পূর্ণ ওষুধ ইনজেক্ট করতে হবে । ওষুধটি আরও ভাল কাজ করবে, যদি আপনার আশেপাশে থাকা কেউ, আপনার বাহুতে বা কাঁধের ব্লেডের মধ্যে ইনজেকশন দিতে পারে ।

মুলফোর্ড ল্যাবরেটরিজ ১৯৩৬ সালে মাকড়সার কামড়ের প্রতিষেধক তৈরী করেন । তখন তারা ল্যাট্রোডেক্টাস ম্যাকটান – ব্ল্যাক উইডো মাকড়সার বিরুদ্ধে একটি অ্যান্টিভেনম আবিষ্কার করেন ।

পরের বছরগুলোতে সাপের কামড়ের অ্যান্টিভেনম আরও বেশী উন্নত হয়েছে । পরবর্তীতে মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি অ্যান্টিভেনম তৈরি করা হয়, যা কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে । মুলফোর্ডের প্রাথমিক অ্যান্টিভেনম পণ্যের মতো, ক্রোফ্যাব অ্যান্টিভেনম হল উত্তর আমেরিকার পিট ভাইপার সাপের বিষের প্রতিষেধক, যার মধ্যে রয়েছে র‍্যাটলস্নেক, কটনমাউথ এবং কপারহেড স্নেক । যেহেতু ক্রোফ্যাব প্রোডাক্ট শুধুমাত্র কালচারড অ্যান্টিবডির একটি অংশ ইউজ করে, তাই এটি পুরানো সিরাম-ভিত্তিক অ্যান্টিভেনম গুলোর তুলনায় কম গুরুতর অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া ঘটায় ।

অ্যান্টিভেনাম কীভাবে তৈরি হয়

মানুষের শরীরে যখন কোন রোগ জীবাণু প্রবেশ করে, তখন শরীরের ইমিউন সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে শুরু করে । আর সেই অ্যান্টিবডিগুলো দেহে প্রবেশকারী রোগ জীবাণুকে আক্রমণ করে এবং ধ্বংস করে । ঠিক একই ভাবে সাপের বিষ মানুষের দেহে প্রবেশ করলে, দেহে বিষের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার কথা । কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সাপের বিষের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করার ক্ষমতা মানুষের দেহে খুবই কম মাত্রায় বিদ্যমান ।

অর্থাৎ সাপের বিষের বিরুদ্ধে, মানুষের দেহে খুব ধির গতিতে এবং অতি স্বল্প সংখ্যক এন্টিবডি তৈরি হয় । কিন্তু এই অ্যান্টিবডি সাপের বিষকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট নয় । পৃথিবীতে খুব কম সংখ্যক প্রাণী রয়েছে , যাদের শরীরে প্রাকৃতিকভাবে সাপের বিষ প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরি হয় ।

যেমনঃ গাধা, ঘোড়া, ভেড়া, ছাগল, মুরগী, উট, খরগোশ, বেজি, ঘোড়া, হাঙ্গর ইত্যাদি । এসব প্রাণিকে সাপে কামড়ালে এদের দেহে প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর পরিমাণে এন্টিভেনাম তৈরি হয় । আর এই সব প্রানীর রক্ত থেকেই এন্টিভেনম আলাদা করা হয় এবং বোতলজাত করে বাজারে বিক্রি করা হয় । বর্তমানে বাণিজ্যিক ভাবে অ্যান্টিভেনম উৎপাদন করার জন্য ঘোড়ার রক্ত সবচেয়ে বেশী ব্যবহার করা হয় ।

গবেষণাগারে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, যদি কোনো প্রাণীর দেহে অল্প পরিমাণে সাপের বিষ প্রবেশ করানো হয় তাহলে কয়েক দিনের মধ্যেই সেই প্রানির দেহে সাপের বিষের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরী হবে এবং সেই অ্যান্টিবডি ঐ প্রানির রক্তে পাওয়া যাবে ।

আসলে এই সিরাম প্রস্তুত করতে শত শত সুস্থ সাপের প্রয়োজন হয় । এই সাপগুলিকে বায়ু চলাচল করতে পারে এমন কাঁচের বাক্সে রাখা হয় এবং কিছু দিন পরে পরে সেই সাপের থেকে বিষ অপসারণ করা হয় এবং পরবর্তী প্রক্রিয়াকরণের জন্য পরীক্ষাগারে পাঠানো হয় ।

আরও পড়ুনঃ কৈলাস পর্বত, কোন বিজ্ঞানী যার রহস্যকে উদঘাটন করতে পারেনি

অ্যান্টিভেনাম প্রস্তুত প্রনালী

প্রথমে একটি ছোট কাচের পাত্রের মুখে নরম কিন্তু স্থিতিস্থাপক পলিথিন কাগজ ভালো করে লাগিয়ে নেয়া হয় । তারপর সাপের বিষ বের করার জন্য, একটি লাঠির সাহায্যে কাচের বাক্স থেকে সাপটিকে বের করা হয় । এবার সাপের মাথা ভালো করে চাপ দিয়ে ধরলে, সাপটি কামড়ানোর জন্য তার দাঁত বের করে এবং রাগান্বিত হয়ে, ছোট কাচের পাত্রের উপরের পলিথিনে দাঁত পুঁততে চেষ্টা করে । এর ফলে সাপের বিষ কাচের পাত্রে জমা হতে থাকে । এই প্রক্রিয়ায় বিষ বের করা হলে, বিষের সাথে সাথে সাপের মুখের ফেনাও কাপে জমা হয়, যা পরবর্তীতে আলাদা করা হয় ।

তবে বর্তমানে আমেরিকার বিজ্ঞানীরা বৈদ্যুতিক শকের মাধ্যমে সাপের বিষ বের করার একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন । এই পদ্ধতিতে, সাপের মাথায় ১০ ভোল্টের বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয় । এর ফলে সাপের বিষ গ্রন্থির সাথে সম্পর্কিত স্নায়ুগুলি প্রভাবিত হয় এবং সেগুলোর সংকোচনের ফলে, সাপের মুখ থেকে বিষ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বের হয়ে আসে । এই পদ্ধতির উদ্ভাবক ডক্টর জনসন মনে করেন, এভাবে বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার কারণে সাপের কোনো সমস্যা হয় না এবং খুব সহজে সাপের বিষ বের করা যায় ।

সাপ থেকে বিষ নিষ্কাশন করার পরে, এটি মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয় এবং বিষ থেকে পানি সরিয়ে আলাদা করা হয় । মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করার ফলে, সাপের বিষ শুকিয়ে কঠিন আকারে পরিণত হয় এবং এর ফলে এটি বহনেও সুবিধা হয় । 

পরের ধাপে এই বিষ প্রানীর শরীরে প্রবেশ করানোর প্রক্রিয়া শুরু হয় । এই প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপে, অ্যান্টিভেনম তৈরির জন্য উপযুক্ত প্রাণী নির্বাচন করা হয় এবং অল্প পরিমাণে বিষ সেই প্রানীর শরীরে প্রবেশ করানো হয় । ঘোড়াকে এই কাজের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে করা হয় । যদিও অনেক সময় ছাগল ও ভেড়াকেও এ কাজের জন্য আনা হয়, তবে ঘোড়াই সবচেয়ে বেশি ইউজ করা হয় । দেহে বিষ ইঞ্জেক্ট করার পর থেকে প্রায় ৩ দিন পর্যন্ত ঘোড়াটি অসুস্থ থাকে । ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যে ঘোড়াটি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে । এই সময়ের মধ্যে ঘোড়ার শরীরে বিষের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে শুরু করে এবং সমস্ত বিষ নষ্ট হয়ে যায় ।

ইমিউনাইজেশন প্রক্রিয়া শুরু করার আগে বিষের সাথে পাতিত পানি এবং কিছু সহায়ক রাসায়নিক যোগ করা হয় । এর ফলে ওই প্রাণীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশী সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং সেই প্রানীর শরীরে দ্রুত অ্যান্টিবডি তৈরি হতে শুরু করে ।খুব সামান্য পরিমাণে (এক বা দুই মিলিলিটার) প্রস্তুত বিষের দ্রবণ একটি ঘোড়ার ত্বকে ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করানো হয় এবং বিষ ইঞ্জেক্ট করার পরে প্রানীগুলোকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয় । প্রায় ৮ থেকে ১০ সপ্তাহের মধ্যে, ঘোড়ার রক্তে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় ।

পরবর্তী ধাপে ঘোড়ার রক্ত ​​বের করে ল্যাবরেটরিতে কালচার করা হয় এবং তা থেকে অ্যান্টিবডি আলাদা করা হয় এবং তা থেকে অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন তৈরি করা হয় । এই ইনজেকশনগুলি খুব কম তাপমাত্রায় রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করা হয় ।

অ্যান্টিভেনামের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

অ্যান্টিভেনাম ইঞ্জেকশনের কারণে সৃষ্ট বেশিরভাগ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য ডাক্তারের পরামর্শের কোন প্রয়োজন হয় না এবং নিয়মিত ব্যবহারে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলি নিজে থেকেই চলে যায় । কিন্তু যদি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অব্যাহত থাকে তাহলে একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন । অ্যান্টিভেনামের কিছু সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিচে দেওয়া হল –

  • মাথাব্যথা
  • বমি বমি ভাব
  • বমি
  • ডায়রিয়া
  • পেট ব্যথা
  • ঠান্ডা
  • পেশী ব্যথা

অ্যান্টিভেনামের দাম

প্রতিটি অ্যান্টিভেনামের ফাইলের দাম প্রায় ১০০০ টাকা । বাংলাদেশে প্রাপ্ত বেশীরভাগ অ্যান্টিভেনম ভারত থেকে আমদানি করা হয় । তবে ধারণা করা হচ্ছে, ২০২২ সালের মধ্যেই বাংলাদেশে অ্যান্টিভেনাম প্রস্তুত করা হবে । সাধারণত একজন সাপে কাটা ব্যক্তির জন্য ৫ থেকে ১০ টি অ্যান্টিভেনাম এর ভায়াল প্রয়োজন হয়, তবে অতিরিক্ত খারাপ অবস্থার ক্ষেত্রে ২০ ভায়াল পর্যন্ত অ্যান্টিভেনাম লাগতে পারে ।

মানুষের দেহে অ্যান্টিভেনম তৈরিকরণ

মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর নয় এমন সহনীয় মাত্রার সাপের বিষ, মানবদেহে নিয়মিত প্রবেশ করালে, রক্ত রসে বিষের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিকভাবে অ্যান্টিভেনাম তৈরি হতে শুরু হয় । প্রত্যেকদিন নিজের শরীরে নিরাপদ মাত্রার বিষ প্রবেশ করানো হলে একসময় দেহে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি হবে এবং এর ফলে ২-৩ টি সাপের কামড় খুব সহজেই প্রতিহত করা যাবে ।

এই প্রক্রিয়াকে মিথরিডেটিসম বলা হয় । পন্টাসের রাজা মিথরিডেটস-৬ নিজের শরীরে অল্প অল্প করে বিষ প্রয়োগ করে বিষের বিরুদ্ধে অ্যান্টিভেনম তৈরি করেছিলেন । স্বাভাবিক মাত্রার যে পরিমাণ বিষে একজন মানুষের মারা যাওয়ার কথা, কিন্তু রাজা মিথরিডেটসের সেই বিষে কিছুই হতো না । নিজ দেহে প্রাকৃতিকভাবে অ্যান্টিভেনম তৈরি করার এই প্রক্রিয়াকে, সেই রাজার নাম অনুসারে মিথরিডেটিসম বলে ।

১৯১০ সালে নিউজার্সির পেটারসনে, বিল হাস্ট জন্মগ্রহণ করেন । ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্ট অনুসারে, সারাজীবনে কোবরা, কমন ক্রেইট, রেটল স্নেক সহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ১৭৩ টি মারাত্মক বিষাক্ত সাপের কামড় খাওয়ার পরেও বিল হাস্টের শরীরে কোনো ধরনের বড় ক্ষতি হতে দেখা যায়নি ।

সাবধানতাঃ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন ধরনের বিষ নিজের শরীরে প্রবেশ করাবেন না । কারণ মাত্রায় সামান্য কমবেশি হলে আপনার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে । আবার দেহ যদি বিষ সহ্য করতে না পারে, তাহলে কিডনি, কলিজা, মস্তিষ্কে সমস্যা দেখা দিতে পারে ।

শেষ কথা

আমাদের বাংলাদেশে সাপের কামড়ে মানুষ মারা যাওয়ার অন্যতম কারণ হল সঠিক সময়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে না যাওয়া । এখনও আমরা সাপে কামড়ানো ব্যক্তিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে না গিয়ে, ওঝার কাছে নিয়ে যাই । আর এই কারনেই বেশীরভাগ রোগী মারা যায় । যদি সঠিক সময়ে সাপে কামড়ানো ব্যক্তিকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া যায় এবং অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা যায়, তাহলে রোগী ১০০% সুস্থ্য হয়ে উঠবে । তাই একটু সচেতন হন এবং সাপ কামড়ানো ব্যক্তিকে ওঝার কাছে নিয়ে না গিয়ে, যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যান । আজকের আর্টিকেলে আমরা আপনাদের সাথে, সাপের বিষের প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভেনম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি । আর্টিকেলটি নিয়ে যে কোন ধরনের প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে কমেন্ট সেকশনে জানান ।

Share on:
Avatar photo

Hello Friends, I am James harden, the founder of this site. This blog provides accurate and precise information on Technology, Banking, Insurance, Tips & Tricks, Online Earning, Computer troubleshooting and much more.

Leave a Comment