উচ্চ রক্তচাপ বা হাই প্রেসার হল একটি অনিয়ন্ত্রিত জীবনধারার ফল । এটি হাই ব্লাড প্রেসার নামেও পরিচিত । এটি এমন একটি অবস্থা, যেখানে ধমনীতে রক্তচাপ স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হয়ে যায় । আমাদের শরীরে স্বাভাবিক অবস্থায় রক্তচাপ ১২০/৮০ এর নিচে থাকে । রক্তের চাপ এর থেকে বেশি হলেই শুরু হয় হাই প্রেসারের সমস্যা । এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ এটি কিডনি, ধমনী এবং হার্টের উপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে ( তথ্যসূত্র ) । অনিয়ন্ত্রিত হাই ব্লাডপ্রেসার, আমাদের মস্তিষ্কের রক্তনালীকে দুর্বল করে স্ট্রোকের কারণ হতে পারে । এই কারণে উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ এবং চিকিৎসা সম্পর্কে সবাইকে সচেতন হতে হবে । আজকের এই আর্টিকেলে আমরা আপনাদের সাথে উচ্চ রক্তচাপ কি ? উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ, চিকিৎসা এবং ঘরোয়া প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব ।
Table of Contents
উচ্চ রক্তচাপ কি – হাই প্রেসার কি
যখন আমাদের হৃৎপিণ্ড স্পন্দিত হয়, তখন এটি আমাদের শরীরের চারপাশে রক্ত পাম্প করে । সেই সাথে এটি প্রয়োজনীয় শক্তি এবং অক্সিজেন সাপ্লাই করে । রক্ত চলাচলের সময় এটি রক্তনালী বা ধমনীর প্রাচীরে ধাক্কা দেয় । এই ধাক্কার শক্তিই মূলত রক্তচাপ বা ব্লাড প্রেসার ।
যদি আপনার ব্লাড প্রেসার খুব বেশি হয়, তাহলে এটি আমাদের হৃদপিণ্ড এবং রক্তনালীগুলিতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে । একে উচ্চ রক্তচাপ বা হাই প্রেসার বলা হয় । চিকিৎসকদের ভাষায় উচ্চ রক্তচাপের সমস্যাকে হাইপারটেনশন বলা হয় । সময়ের সাথে সাথে এটি স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, কিডনি রোগ এবং কিছু ধরণের ডিমেনশিয়া সহ বেশ কিছু ধরনের রোগ তৈরি করতে পারে ।
বর্তমান সময়ে উচ্চ রক্তচাপ খুবই সাধারণ, বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের এই রোগ রয়েছে, কিন্তু তাদের বেশিভাগ মানুষ এটি সম্পর্কে সচেতন নয় । কারণ এতে সাধারণত কোনো লক্ষণ থাকে না তাই আপনার এটি আছে কি না, তা জানার একমাত্র উপায় হল ব্লাডপ্রেসার টেস্ট করা ।
রক্তচাপকে ২ ধরনের সংখ্যা দিয়ে রেকর্ড করা হয় । এর একটিকে বলে সিস্টোলিক চাপ এবং অন্যটি হল ডায়াস্টোলিক চাপ । সিস্টোলিক এবং ডায়াস্টোলিক উভয়ই “পারদ পার মিলিমিটার” (mmHg) এ পরিমাপ করা হয় । পরিক্ষা করার পর রক্তের চাপ যদি ১২০/৮০ mm Hg হয় তাহলে তা স্বাভাবিক বলে মনে করা হয় । কিন্তু যদি ১৪০/৯০ mm Hg বা তার বেশি রক্তচাপ পাওয়া যায় তাহলে তা উচ্চ রক্তচাপ বলে বিবেচিত হয় । আর আপনার রক্তচাপ যদি ১২০/৮০ এবং ১৩৯/৮৯ এর মধ্যে থাকে, তাহলে আপনার প্রি-হাইপারটেনশন পর্যায়ে রয়েছেন । অর্থাৎ আপনার এখন হাই প্রেসারের সমস্যা নেই, তবে ভবিষ্যতে আপনার এটি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ।
উচ্চ রক্তচাপের প্রকারভেদ – উচ্চ রক্তচাপ কত প্রকার
উচ্চ রক্তচাপ সাধারণত ২ প্রকার –
- প্রাইমারী ব্লাড প্রেসার – এই ধরনের রক্তচাপকে প্রাথমিক বা এসেনশিয়াল উচ্চ রক্তচাপ বলা হয় । এটি হাই ব্লাডপ্রেসারের সবচেয়ে সাধারণ ধরন । এই ধরনের হাই প্রেসারের কোন নির্দিষ্ট কারণ নেই । এই ধরনের হাই প্রেসারের সমস্যা ব্যক্তির বয়স, জিন, খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রার কারণে হয়ে থাকে । বেশিরভাগ মানুষই এই ধরনের উচ্চ রক্তচাপের শিকার হয় ।
- সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন – এই ধরনের উচ্চ রক্তচাপ, অন্য কোনো রোগ বা ওষুধ সেবনের কারণে হয়ে থাকে । আপনি যদি চিকিৎসা বা ওষুধ গ্রহণ করা বন্ধ করেন তবে এই অবস্থা আরও বেশী গুরুতর হয়ে উঠতে পারে ।
এছাড়াও আরও কিছু ধরনের হাইপারটেনশন রয়েছে –
- Malignant hypertension
- Isolated systolic hypertension
- White coat hypertension
- Resistant hypertension
আরও পড়ুনঃ পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর ঘরোয়া উপায়
উচ্চ রক্তচাপের কারণ – উচ্চ রক্তচাপ কেন হয়
উচ্চ রক্তচাপ কেন হয় তা জানা থাকলে এই সমস্যা অনেকাংশে এড়ানো যায় । আসুন জেনে নিই উচ্চ রক্তচাপের কারণ কি কি –
- ধূমপান – অতিরিক্ত ধূমপানের কারণে রক্তনালী সরু হয়ে যায়, ফলে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা হতে পারে ।
- স্থূলতা – যাদের ওজন বেশি বা যারা বেশী মোটা, তাদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ওজনের মানুষের তুলনায় উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে । তবে এর মানে এই নয় যে, চিকন মানুষের হাই ব্লাড প্রেসারের সমস্যা হবে না । চিকন মানুষের ক্ষেত্রেও হাই ব্লাড প্রেসারের সমস্যা হতে পারে ।
- শারীরিক কার্যকলাপ – শারীরিক কার্যকলাপ কম করা বা ব্যয়াম না করার কারণে হাই প্রেসারের সমস্যা হতে পারে ।
- খাবারে অত্যধিক লবণ খাওয়া বা কাঁচা লবন খাওয়া – যারা প্রতিদিনের খাবারে টোটকা বা কাঁচা লবন খান তাদের মধ্যে হাই ব্লাডপ্রেসারের সমস্যা বেশী দেখা যায় ।
- বংশগতি – যদি আপনার পরিবারের কোন সদস্যের (মা, বাবা) হাই প্রেসারের সমস্যা থাকে তবে আপনার এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ।
- স্ট্রেস বা মানসিক চাপ – গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, ব্লাড প্রেসারের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে ।
- থাইরয়েড – যাদের থাইরয়েডের সমস্যা রয়েছে তাদের উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকি বেশী ।
- দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ – কিডনি সম্পর্কিত বিভিন্ন রোগের কারণে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে ।
- স্লিপ অ্যাপনিয়া (গুরুতর ঘুমের ব্যাধি) – স্লিপ অ্যাপনিয়ার কারণেও হাই প্রেসারের সমস্যা দেখা দিতে পারে ।
- উচ্চ চর্বিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ – নিয়মিত বেশী চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহন করলে হাই প্রেসারের সমস্যা হতে পারে ।
- গর্ভাবস্থা – গর্ভকালীন সময়ে উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকি বেশী থাকে ।
উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ – উচ্চ রক্তচাপের উপসর্গ
উচ্চ রক্তচাপকে ‘নীরব ঘাতক’ বলা হয়, কারণ এটি বেশীরভাগ সময় কোন ধরনের লক্ষণ প্রকাশ করে না । উচ্চ রক্তচাপের কিছু লক্ষণ নিচে দেওয়া হল –
- একটানা মাথাব্যথা
- মাথা ঘোরা
- ক্লান্তি অনুভব করা
- বুকে ব্যাথা হওয়া
- দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়ে যাওয়া
- শ্বাসকষ্ট
- নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ
উচ্চ রক্তচাপের ঘরোয়া প্রতিকার
উচ্চ রক্তচাপের জন্য নীচের ঘরোয়া প্রতিকারগুলি অবলম্বন করতে পারেন । এগুলো কিছু পরিমাণে আপনার উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করবে । তবে মনে রাখবেন যে এগুলো হাই প্রেসারের জন্য কোন নিরাময় নয়, এগুলো হল উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করার উপায় । উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা যদি বেশী হয়ে উঠতে থাকে, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করুন ।
রসুন – আপনি প্রতিদিন সকালে এবং সন্ধ্যায় ১ বা ২ কোয়া রসুন এক চামচ মধুর সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন । এছাড়া আপনি রসুন রান্নায়ও ব্যবহার করতে পারেন । রসুন ব্যবহার করে অনিয়ন্ত্রিত হাই প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করা যায় । রসুন ১০ mmHg সিস্টোলিক এবং ৮ mmHg পর্যন্ত ডায়াস্টোলিক চাপ কমাতে পারে । S-L-cysteine একটি বায়োঅ্যাকটিভ সালফার যৌগ, যা রসুনের মধ্যে পাওয়া যায় । এটি উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে ।
তেতুল – আপনি যদি বুঝতে পারেন যে, আপনার ব্লাড প্রেশার বেড়ে গেছে তাহলে দ্রুত ব্লাড প্রেসার কমানোর জন্য তেতুল ব্যবহার করতে পারেন । এমন অবস্থায় ১ গ্লাস পানিতে পাকা তেতুল গুলে নিন ( লবন ব্যবহার করবে না )। এরপর সেই তেতুল পানি পান করুন । দ্রুত প্রেশার কমাতে তেতুল পানি খুব কার্যকরী ।
আমলা – এক গ্লাস খাবার পানির সাথে দুই চামচ আমলার রস মিশিয়ে নিয়ে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে পান করুন । আমলা উচ্চ রক্তচাপের ঘরোয়া প্রতিকার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে । আমলার হাইপোলিপিডেমিক এবং অ্যান্টিহাইপারটেনসিভ প্রভাব রয়েছে যা ব্লাডপ্রেশার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে । হাইপোলিপিডেমিক প্রভাব ধমনীর প্রাচীরে চর্বি, কোলেস্টেরল এবং অন্যান্য পদার্থের বিল্ড আপ প্রতিরোধ করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে কাজ করে ।
মেথি বীজ – এক গ্লাস হালকা গরম পানি নিয়ে তাতে আধা চা চামচ মেথির বীজ সারারাত ভিজিয়ে রাখুন। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার সাথে সাথে খালি পেটে ছেঁকে নিয়ে এই পানি পান করুন । উচ্চ রক্তচাপ বা হাই প্রেসারের ঘরোয়া প্রতিকারের মধ্যেও মেথি অন্তর্ভুক্ত । মেথি খারাপ কোলেস্টেরল কমিয়ে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে । একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, মেথি পলিফেনল এবং ফ্ল্যাভোনয়েড সমৃদ্ধ যা শরীরের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে । এছাড়াও, মেথির মিথানল নির্যাসে অ্যান্টিহাইপারটেনসিভ প্রভাব রয়েছে । এই প্রভাব ক্রমবর্ধমান রক্তচাপ নরমাল করতে সাহায্য করতে পারে । এসব কারণে, মেথিকে উচ্চ রক্তচাপের জন্য একটি ঘরোয়া প্রতিকার হিসাবে মনে করা হয় ।
মধু – ১ গ্লাস পানি হালকা গরম করে তাতে ১ চা চামচ মধু মিশিয়ে নিয়ে পান করুন । মধু হাই ব্লাডপ্রেসার নিয়ন্ত্রণে খুব ভাল কাজ করে । একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মধুতে উপস্থিত Quercetin (এক ধরনের পলিফেনল) রক্তচাপের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে কাজ করে । এছাড়াও, এটি মনে করা হয় যে মধুর ব্যবহার রক্তচাপকে অত্যধিকভাবে কমিয়ে ফেলতে পারে ।
পেঁয়াজের রস – হাফ চামচ মধুর সাথে ১ চা চামচ পেঁয়াজের রস ভালো করে মিশিয়ে নিয়ে প্রতিদিন সকালে এবং সন্ধ্যায় পান করুন । পেঁয়াজে কোয়ারসেটিন নামক পলিফেনল থাকে, যা হাই প্রেশার নিয়ন্ত্রণ করতে দারুণ সহায়ক বলে মনে করা হয় । একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ৬ সপ্তাহ ধরে পেঁয়াজের রস খান তাদের রক্তচাপ অনেকটা কমে গেছে । এই কারণে পেঁয়াজের রসকে হাই প্রেশারের ঘরোয়া প্রতিকার হিসেবে বিবেচনা করা হয় ।
আদা – ১ চামচ আদার রস ১ কাপ পানির সাথে মিশিয়ে পান করুন । এছাড়াও আপনি প্রতিদিনের রান্নায় আদা ব্যবহার করতে পারেন । আবার চায়ের সাথে আদা মিশিয়ে আদা চা খেতে পারেন । আদার মাধ্যমেও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা যায় । এটির একটি হাইপোটেনসিভ প্রভাব রয়েছে, যা ব্লাড প্রেসার কমাতে সাহায্য করে । একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, আদার রস একটানা ৮ সপ্তাহ ধরে সেবন করলে সিস্টোলিক এবং ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ অনেকটা কমে যায় । ডায়াবেটিস রোগীরা আদার মাধ্যমে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন । এসব কারণেই আদাকে উচ্চ রক্তচাপের প্রতিকার হিসেবে মনে করা হয় ।
তরমুজ – প্রতিদিন ১ বাটি করে তরমুজ খান । আবার আপনি চাইলে তরমুজের জুস করেও খেতে পারেন । তরমুজ খুব উপকারী একটি ফল, যা উচ্চ রক্তচাপ কমানোর জন্য খাওয়া যেতে পারে । আসলে, তরমুজের মধ্যে অ্যামিনো অ্যাসিড এল-সিট্রুলাইন থাকে, যা প্রেশার কমাতে সাহায্য করে । যদিও হাই প্রেসারের রোগীদের জন্য তরমুজ খুব ভাল, কিন্তু এটি একটি উচ্চ গ্লাইসেমিক সূচক খাদ্য । এই কারণে, ডায়াবেটিস রোগীদের এটি বেশী পরিমাণে খাওয়া ঠিক নয় ।
দারুচিনি গুঁড়া – ১ গ্লাস হালকা গরম পানির সাথে ১ চামচের ৪ ভাগের ১ ভাগ দারুচিনি গুঁড়া মিশিয়ে নিয়ে পান করুন । বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা যায় দারুচিনির মাধ্যমে । একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দারুচিনি সিস্টোলিক এবং ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ উভয়ই কমাতে খুব ভাল কাজ করে ।
লেবু – ১ গ্লাস হালকা গরম পানির সাথে অর্ধেক লেবুর রস মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে পান করুন । হাই প্রেশারের উপসর্গ এড়াতে বা কমাতে লেবু খুব কার্যকরী ভুমিকা পালন করে । পৃথিবীর অনেক দেশে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ঘরোয়া প্রতিকার হিসাবে লেবু ব্যবহার করা হয় । একটি গবেষণা অনুসারে, প্রতিদিন লেবু খেলে সিস্টোলিক রক্তচাপ কমে । ইঁদুরের উপর করা এই গবেষণায় দেখা গেছে যে, লেবুর রস এবং এর ফ্ল্যাভোনয়েড সিস্টোলিক রক্তচাপ কমাতে সক্ষম । এছাড়াও, লেবুর খোসার জলীয় নির্যাসও ব্লাডপ্রেশার কমাতে পারে ।
গাজর – গাজর পরিষ্কার পানি দিয়ে ভাল করে ধুয়ে নিয়ে ব্লেন্ডারে দিয়ে জুস তৈরি করুন । প্রতিদিন সকালে খালি পেটে গাজরের জুস পান করুন । উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গাজর খুব ভাল কাজ করে । ফাইবার, পটাসিয়াম, নাইট্রেটস এবং ভিটামিন সি সহ গাজরের রসে উপস্থিত অন্যান্য পুষ্টি উপাদান ব্লাড প্রেশার কমাতে সহায়ক ভুমিকা পালন করে । গবেষণায় দেখা গেছে যে, গাজরের রস বা জুস সিস্টোলিক রক্তচাপ ৫% পর্যন্ত কমাতে সক্ষম । এইসমস্ত কারণে, গাজরের রস হার্ট এবং কিডনির জন্যও উপকারী বলে মনে করা হয় । এ কারণেই গাজর হাই প্রেশারের প্রতিকার হিসেবে পরিচিত ।
কলা – প্রতিদিন ২-৩টি পাকা কলা খান । আপনি চাইলে সকালের নাস্তায় প্রতিদিন কলা খেতে পারেন । উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে কলা ব্যবহার করা যেতে পারে । কলাতে পটাসিয়াম রয়েছে, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে । এ কারণেই হাই প্রেসারের ওষুধ খাওয়ার পরিবর্তে সবসময় ফলকে প্রাধান্য দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় ।
মূলা – মুলা ও মুলার পাতা খাবার সময় সালাদ হিসেবে খেতে পারেন । আবার আপনি চাইলে মূলার পাতা ভাজি করেও খেতে পারেন । NCBI এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুসারে, মূলার পাতার মধ্যে অ্যান্টিহাইপারটেনসিভ প্রভাব রয়েছে ।আর এই অ্যান্টিহাইপারটেনসিভ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে । তাই মূলার পাতা ব্যবহার করলে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা কিছুটা কমতে পারে ( তথ্যসূত্র ) ।
আপেল সিডার ভিনেগার – ১ গ্লাস হালকা গরম পানির সাথে ১ চা চামচ আপেল সিডার ভিনেগার ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে পান করুন । আপেল সাইডার ভিনেগার শরীরে রক্তচাপের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে । আপেল সিডার ভিনেগারে অ্যাসিটিক অ্যাসিড রয়েছে । এই অ্যাসিটিক অ্যাসিডের অ্যান্টিহাইপারটেনফসিভ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা ব্লাড প্রেসার কমাতে পারে ।
উচ্চ রক্তচাপের অসুবিধা – উচ্চ রক্তচাপের জটিলতা
উচ্চ রক্তচাপ আমাদের ধমনীর প্রাচীরে প্রচুর পরিমাণে চাপ প্রয়োগ করে । যার ফলে আমাদের শরীরে উপস্থিত রক্তকণিকা ও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয় । ব্লাডপ্রেসার যত বেশি হবে, আমাদের শরীরের তত বেশি ক্ষতি হবে ।
উচ্চ রক্তচাপের কারণে নিম্নলিখিত সমস্যাগুলো হতে পারে –
- হার্ট অ্যাটাক– হাই প্রেসারের কারণে কোষগুলো মোটা ও শক্ত হয়ে যায়, যার ফলে হার্ট অ্যাটাক বা অন্যান্য জটিলতা দেখা দিতে পারে ।
- অ্যানিউরিজম – উচ্চ রক্তচাপ আমাদের দেহের কোষগুলিকে দুর্বল করে এবং বাইরের দিকে প্রসারিত করে, এর ফলে একটি অ্যানিউরিজম তৈরি হয় (ধমনীর প্রাচীরে অত্যধিক ফোলাভাব) । অ্যানিউরিজম ফেটে যাওয়ার কারণে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে ।
- হার্ট ফেইলিওর – কোষে অতিরিক্ত চাপের বিরুদ্ধে রক্ত পাম্প করার কারণে হৃদপিণ্ডের পেশী ঘন হয়ে যায় । অবশেষে, ঘন পেশীর কারণে হার্ট পর্যাপ্ত রক্ত পাম্প করতে ব্যর্থ হয়, যার ফলে হার্ট ফেইলিওর হতে পারে ।
- কিডনি দুর্বল – এটির কারণে আপনার কিডনি সঠিকভাবে কাজ করতে বাধাগ্রস্থ হয় ।
- চোখের রক্তকণিকা দুর্বল বা সঙ্কুচিত – এর ফলে আপনার দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি বা নষ্ট হতে পারে ।
- মেটাবলিক সিনড্রোম – মেটাবলিক সিনড্রোম হল আমাদের শরীরের বিপাক সংক্রান্ত ব্যাধিগুলির একটি গ্রুপ । এটি আমাদের ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং হার্ট অ্যাটাকের মতো রোগ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায় ।
- মস্তিষ্ক সম্পর্কিত সমস্যা – অনিয়ন্ত্রিত হাই ব্লাডপ্রেশার আপনার চিন্তা করার, মনে রাখার এবং শেখার ক্ষমতার উপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে ।
আরও পড়ুনঃ ডায়াবেটিস কি ? ডায়াবেটিসের লক্ষণ এবং ঘরোয়া প্রতিকার
উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধের উপায়
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম, নিয়মিত ব্যায়াম এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মাধ্যমে আপনি আপনার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন । রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রেখে আপনি আপনার হৃদরোগ ও স্ট্রোক সহ আর অনেক রোগের ঝুঁকি কমাতে পারবেন । হাই প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিম্নলিখিত উপায়গুলো অবলম্বন করুন –
- স্বাস্থ্যকর খাবার খান – উচ্চ রক্তচাপ এবং এর জটিলতা এড়াতে প্রতিদিনের ডায়েটে স্বাস্থ্যকর খাবার অন্তর্ভুক্ত করুন । প্রচুর পরিমাণে তাজা ফল (মৌসুমি ফল) এবং সবুজ শাক-সবজি খান ।
- ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন – অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতার কারণে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ে । তাই স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহন করার পাশাপাশি ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করুন ।
- শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকুন – শারীরিক কার্যকলাপ আপনার ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং ব্লাড প্রেসার কমাতে সাহায্য করতে পারে । সপ্তাহে কমপক্ষে 5 দিন 30 মিনিট করে ব্যায়াম করার অভ্যাস করুন ।
- ধূমপান করবেন না – ধূমপান, আপনার ব্লাড প্রেসার বাড়ানোর পাশাপাশি হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায় । তাই যত দ্রুত সম্ভব সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিন ।
- মদ্যপান কম করুন – অ্যালকোহল ব্লাড প্রেশার বাড়ায় । তাই অ্যালকোহল বা মদ কম পান করার চেষ্টা করুন ।
- পর্যাপ্ত ঘুমান – পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম আপনার সামগ্রিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি আপনার হার্ট এবং রক্তনালী ভাল রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ । নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম না হওয়া, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ,এবং স্ট্রোকের অন্যতম প্রধান কারণ ।
- মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ – অতিরিক্ত মানসিক চাপ, হাই প্রেশার সহ অনেক ধরনের শারীরিক অসুস্থতার মূল কারণ । তাই হাই প্রেসার থেকে মুক্তি পেতে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি । অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে আমাদের শরীরে ভাসোকনস্ট্রিকশন হরমোনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় । এই হরমোন রক্তনালীকে সংকুচিত করে এবং হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে হাই প্রেসারের সমস্যা তৈরি করতে পারে ( তথ্যসূত্র )। মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করে রক্তচাপের ভারসাম্য ঠিক রাখা যায় ।
উচ্চ রক্তচাপের ডায়েট
উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধের জন্য আপনার ডায়েটের দিকে নজর দেয়া উচিত । আপনার প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ফল, কম চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত পণ্য, সবুজ শাক-সবজি এর মতো খাবার অন্তর্ভুক্ত করুন ।
উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা – হাই প্রেসারের চিকিৎসা
উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার জন্য, ডাক্তার আপনাকে রক্তচাপ কমানোর ওষুধ ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন । এই চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হল রক্তচাপ স্বাভাবিক বা নিয়ন্ত্রণে রাখা । এছাড়াও, ডাক্তার আপনার প্রতিদিনের জীবনধারায় কিছু পরিবর্তনের পরামর্শ দিতে পারেন ।
শেষ কথা
উচ্চ রক্তচাপ হল এমন একটি শারীরিক সমস্যা, যা পুরোপুরি নির্মূল করা যায় না । তবে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় । আজকের এই আর্টিকেলে উল্লিখিত ঘরোয়া প্রতিকারগুলিকে আপনার জীবনধারার একটি অংশ করে তোলার মাধ্যমে আপনার উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণগুলি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন । চিকিৎসকেরা উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার জন্য ওষুধের পাশাপাশি প্রতিদিনের রুটিন পরিবর্তনের পরামর্শ দেন । আজকের আর্টিকেলে উচ্চ রক্তচাপের কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে । আর্টিকেলটি নিয়ে যে কোন ধরনের প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে কমেন্ট সেকশনে জানান ।