কানের ব্যথার কারণ ও ঘরোয়া প্রতিকার

কান ব্যথা একটি খুব সাধারণ রোগ, যা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রভাবিত করে। সাধারণত এই সমস্যাটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের মধ্যে দেখা যায়। কানের ব্যথা দুই প্রকার। একটি ব্যথা কানের ভিতরে এবং অন্য ব্যথা কানের বাইরে হয় যা ইঙ্গিত দেয় যে আপনার কানে কিছু সমস্যা আছে এবং আপনার দ্রুত একজন ডাক্তার দেখানো উচিত। আজকের আর্টিকেলে আমরা কানের ব্যথার কারণ ও ঘরোয়া প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব।

এই রোগের চিকিৎসার জন্য বাজারে অনেক ধরনের ঔষধ পাওয়া যায়, যা এই কানের ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে খুবই সহায়ক প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু অনেক সময় এই ওষুধগুলি রোগীর উপর অন্য রকম প্রভাব ফেলে অর্থাৎ এই ঔষধ গুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে । এই সব ঔষধ খাওয়ার পর রোগী তার কানের ব্যথা থেকে সাময়িক মুক্তি পায়, কিন্তু অনেক সময় কানের ভিতরে ছড়িয়ে পড়া সংক্রমণ দূর করতে সক্ষম হয় না, যার কারণে পরবর্তীতে আবার সমস্যা দেখা দেয়।

কানের ব্যথার কারণ 

কানে ব্যথা অনেক কারণে হতে পারে। কানে ব্যথা হওয়ার কমন কিছু কারণ নিচে দেওয়া হল –

কানের ময়লা

কানের ভেতরে ময়লা জমে যাওয়ার কারণে অনেক সময় কানে ব্যথা হয়। যেসব মানুষের ত্বক তৈলাক্ত, তাদের কানের ভেতরে ময়লা জমার সমস্যা বেশি দেখা যায়। কান থেকে ময়লা বের করে নেওয়ার কয়েক দিন পর এটি পুনরুজ্জীবিত হয়। দীর্ঘ সময় কানে থাকার পর, ময়লা শুকিয়ে যায় এবং তারপর কানের গর্ত ব্লক করে দেয়, যার কারণে কানে ব্যথা শুরু হয় এবং একই সাথে শ্রবণশক্তি ধীরে ধীরে কমতে থাকে। 

কানের পর্দায় আঘাতের কারণে 

কানের ভিতরের পর্দাটি খুবই সংবেদনশীল। তাই এর উপর সামান্য চাপ বা আঘাতের কারণে কানে ব্যথা হতে পারে। এর পাশাপাশি, এটি থেকে পুঁজও আসতে শুরু করে। দীর্ঘদিন ধরে এমন অবস্থার কারণে কানের আশেপাশের হাড়েও সমস্যা শুরু হতে পারে।  

ইউস্টাচিয়ান টিউব ব্লকেজ

নাকের পিছনে এবং গলার উপরের অংশে একটি খাঁজের সাথে কান সংযুক্ত থাকে এবং এই কারণেই টনসিল বা সাইনাস হলে কানের ভিতরে ব্যথা হয়। কানে প্রদাহের কারণে, ইউস্টাচিয়ান টিউব ব্লক হয়ে যায় এবং তারপর এটি থেকে পুঁজ আসতে শুরু করে। যা কানের পর্দার ক্ষতি করে। এছাড়াও, যখন মহিলারা তাদের বাচ্চাদের দুধ খাওয়ান, কখনও কখনও দুধ তাদের মধ্য কানে পৌঁছায়, যার কারণে অনেক সময় ইনফেকশন হয়। আর এই ইনফেকশনের ফলে কানে ব্যথা হয় এবং পুঁজ আসতে শুরু করে।    

ওটিটিস মিডিয়ার কারণে 

এটি কানের মাঝখানে তৈরি হওয়া একটি সংক্রমণ, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের মধ্যে ঘটে। ডব্লিউএইচও এর মতে এই সংক্রমণ যদি দুই সপ্তাহের বেশি স্থায়ী থাকে তবে তা ক্রনিক ইনফেকশন বলে বিবেচিত হয়। সাধারনত ঠান্ডা, ফ্লু ভাইরাস এবং ধুলো অ্যালার্জির কারণে এই ধরনের ইনফেকশন হয়ে থাকে। এই ইনফেকশনের কারণে উচ্চ জ্বর, কানে ব্যথা, শ্রবণে সমস্যা এবং কান থেকে পুঁজ বের হতে পারে। 

সাইনাস ইনফেকশনের কারণে

এই সংক্রমণ সাধারনত ভাইরাস, ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়ে থাকে। সাইনাসে সংক্রমণের কারণে কানের ভেতরে বাতাসের চাপে তারতম্য তৈরি হয়, যার কারণে কানে ব্যথা অনুভুত হয়। 

আরও পড়ুনঃ কিভাবে আপনার হলুদ দাঁত সাদা করবেন

অটোইমিউডিটি 

আর্দ্রতার কারণে বর্ষাকালে কানে ফাঙ্গাল ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কানের রোগীদের শীতল বা এয়ার কন্ডিশনের সামনে ঘুমানো উচিত নয় কারণ এটি কানে তীব্র ব্যথা এবং চুলকানি সৃষ্টি করতে পারে। 

কানের বারোট্রমা 

এই অবস্থায় পানি বা বাতাসের বাহ্যিক চাপের কারণে কানের অভ্যন্তরীণ অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কানের বারোট্রমা সাধারণত স্কাই ডাইভিং, স্কুবা ডাইভিং এবং প্লেন ফ্লাইটের সময় অনুভূত হয়। বারোট্রোমার কারণগুলির মধ্যে রয়েছে ঘাড় ফুলে যাওয়া, শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ, অ্যালার্জির কারণে তীব্র ঠান্ডা ইত্যাদি।  

কানের ব্যথার ঘরোয়া প্রতিকার

কানের ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অনেক ধরনের ঘরোয়া প্রতিকার রয়েছে, যা ব্যবহার করে আপনি এই রোগ থেকে বাঁচতে পারেন। নিচের পদ্ধতি গুলো ব্যবহার করার আগে আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত।

সরিষার তেলের মাধ্যমে: সরিষার তেল কানের ময়লা পরিষ্কার করার জন্য সেরা বলে মনে করা হয়। উভয় কানে 3-4 ফোঁটা তেল দিন। এক কানে তেল দেওয়ার পর, প্রায় 15 মিনিট পর, অন্য কানে তেল দিন। 

তুলসী পাতার মাধ্যমে: কানের ব্যথার চিকিৎসার জন্য তুলসী পাতা একটি ভালো ওষুধ। এর পাতা থেকে রস বের করে ব্যাথার কানে লাগালে আরাম পাওয়া যায়।

নিম পাতার মাধ্যমে: নিমের পাতায় অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা কানের ব্যথায় কার্যকরী প্রমাণিত হয়। নিম পাতা থেকে রস বের করার পর, এর 2-3 ফোঁটা ব্যাথা কানে লাগালে ব্যথা কমে যায়।

রসুনের মাধ্যমে: রসুনের দুটি কোয়া ভালোভাবে পিষে নেওয়ার পর, সেগুলো দুই চামচ সরিষার তেলে মিশিয়ে নিন এবং কালো হওয়া পর্যন্ত ফুটিয়ে নিন। ফোটানোর পরে, মিশ্রণটিকে ঠান্ডা করে, ব্যথা কানে ২-৩ ফোঁটা দিন। এটি কানের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। 

আদার মাধ্যমেঃ আদা এর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের জন্য ব্যথা কমাতে সহায়তা করে। এছাড়াও আদার অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আদার রস হালকা গরম করে যে কানে ব্যাথা তার চারপাশে লাগান (কানের বাহিরের অংশে লাগাবেন)।

অলিভ অয়েলের মাধ্যমে: যদি কানে তীব্র ব্যথা হয়, অলিভ অয়েল হালকা গরম করার পর, এর 3-4 ফোঁটা আপনার কানে রাখুন। এটি ব্যথায় তাত্ক্ষণিক স্বস্তি দেবে। 

পেঁয়াজের মাধ্যমে: পেঁয়াজের অ্যান্টিসেপটিক এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা কানের ব্যথা কমাতে সহায়ক। পেঁয়াজ থেকে রস বের করার পর তা গরম করে তারপর ব্যবহার করুন।  

একটি গরম পানির বোতলের মাধ্যমে: ব্যথার কানের কাছে একটি গরম পানির বোতল রাখুন। এর ফলে আপনার কানের ভেতরে গরম অনুভব হবে, যা আপনার কানের ব্যথা কমাতে সাহায্য করবে।

গরম সেকঃ কানে গরম সেক দিলে প্রচণ্ড ব্যথাতেও অনেক আরাম পাওয়া যায়। যদি আপনার কান থেকে পুঁজ বের হয় তাহলে কানে গরম সেঁক দিন। এর ফলে আপনার কানের মধ্যে জমে থাকা পুঁজ বেরিয়ে যাবে, এবং সেই সাথে ব্যথাও অনেকটা কমে যাবে। একটি পরিষ্কার কাপড় গরম পানিতে ভিজিয়ে ভালোভাবে নিংড়ে নিন। তারপর যে কানে ব্যথা, সেই কানের উপরে ভেজা কাপড়টা দিয়ে ২-৩ মিনিট রাখুন। তারপর আপনার মাথাটি অন্যদিকে কাত করে পুঁজ বের করে দিন।

আরও পড়ুনঃ অতিরিক্ত ওজন কমানোর ঘরোয়া উপায়

হাইড্রোজেন পারক্সাইড ড্রপঃ আপনার আশেপাশের যে কোনও ওষুধের দোকানে হাইড্রোজেন পারক্সাইড ড্রপ পাবেন। কানের ইনফেকশন কমাতে এবং পুঁজ শুকোতে এই ড্রপটি খুব ভালো কাজ করে। ড্রপারে করে ৩ থেকে ৪ ফোঁটা ব্যথার কানে দিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকুন । তারপর মাথা উল্টোদিকে কাত করে কানের ভেতরের তরলটা বের করে দিন। ধীরে ধীরে আপনার কানের ইনফেকশন এবং ব্যথা কমে যাবে।

ওভার দ্য কাউন্টার ড্রাগসঃ যেসব ওষুধ ডাক্তারের পরামর্শ বা প্রেসক্রিপশন ছাড়াই তাৎক্ষণিক ভাবে ব্যবহার করা যায় সেগুলোকে ওভার দ্যা কাউন্টার ড্রাগ বলা হয়ে থাকে। নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ড্রাগস (NSAIDs) সাময়িকভাবে আপনার কানের ব্যথা কমাতে সক্ষম। আপনারা নিচে দেওয়া ড্রাগস গুলো ব্যবহার করে দেখতে পারেন –

নোটঃ শিশুদের ক্ষেত্রে অ্যাসপিরিন ব্যবহার করা উচিত নয়। শিশুদের ক্ষেত্রে ব্যবহারের আগে অবশ্যই ডক্টরের পরামর্শ নিন।

কানে ব্যথা হলে করনীয়

কান শুকনো রাখুনঃ গোসল করার সময় কানে যেন কোনভাবেই পানি ঢুকতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখুন। প্রয়োজনে গোসল করতে যাওয়ার আগে কানে পেট্রোলিয়াম জেল লাগানো তুলো গুঁজে নিন।

কান খোঁচাবেন নাঃ আমাদের মধ্যে অনেকেই কানে ব্যথা হলে কানের ভেতরে খোঁচাখুঁচি করি। এর ফলে ইনফেকশন আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কানে ব্যাথা হলে কোন অবস্থাতেই কোনওরকম ইয়ারবাড, দেশলাই কাঠি, সেফটিপিন জাতীয় জিনিস কানের ভেতরে ঢোকাবেন না, তাতে সমস্যা আরও জটিল হবে।

কানে চাপ না দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করাঃ আপনার যে কানে ব্যথা সেই কানে যেন ঘুমের সময় চাপ না লাগে সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে অতিরিক্ত বালিশ দিয়ে মাথা উঁচু করে ঘুমাতে পারেন এবং সম্ভব হলে নরম বালিশ ব্যবহার করুন।

শেষ কথা

সমস্যা যাই হোক না কেন, রোগীর যে কোন ধরনের ঔষধ খাওয়ার আগে বা ঘরোয়া চিকিৎসা গ্রহণের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। একজন কান বিশেষজ্ঞ, কানের ব্যথা ভালোভাবে বোঝার জন্য একটি অটোস্কোপ বা অরিস্কোপ ব্যবহার করেন, যার সাহায্যে তিনি কানের ব্যথার সঠিক কারণ জানতে পারেন এবং তারপর অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নেন। বেশিরভাগ সময় কানে ময়লা জমে থাকার কারণে ব্যথা হয়, এমন পরিস্থিতিতে ডাক্তার কান পরিষ্কার করার পরামর্শ দেন।

আর্টিকেলটি নিয়ে যে কোন ধরনের প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে কমেন্ট সেকশনে জানান।

ধন্যবাদ

 

Share on:
Avatar photo

Hello Friends, I am James harden, the founder of this site. This blog provides accurate and precise information on Technology, Banking, Insurance, Tips & Tricks, Online Earning, Computer troubleshooting and much more.

Leave a Comment