থ্যালাসেমিয়া কি এবং এর লক্ষণ ও প্রতিকার

সাম্প্রতিক সময়ে থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা অপ্রত্যাশিতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে প্রতিনিয়ত কতজন থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত তার কোনো সঠিক তথ্য নেই। থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তের চাহিদা বাড়ছে বলেও স্বীকার করছে স্বাস্থ্য বিভাগ। লক্ষণীয় বিষয় হল, থ্যালাসেমিয়া একটি জেনেটিক রক্ত ​​সংক্রান্ত রোগ, যাতে রোগীর শরীরে লোহিত রক্ত ​​কণিকা এবং হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিকের চেয়ে কম হয়ে যায়। আজকের আর্টিকেলে আমরা আপনাদের সাথে থ্যালাসেমিয়া কি এবং এর লক্ষণ ও প্রতিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

থ্যালাসেমিয়া কি

থ্যালাসেমিয়া একটি জেনেটিক রোগ যাতে শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায়। এই রোগটি জেনেটিক হওয়ায় বংশ পরম্পরায় পরিবারে চলে। এ রোগে শরীরে লোহিত কণিকা তৈরি হয় না এবং যেগুলো তৈরি করা যায়, সেগুলো কিছু সময়ের জন্যই থাকে। একজন সুস্থ মানুষের শরীরে লোহিত রক্ত ​​কণিকার সংখ্যা প্রতি ঘন মিলিমিটারে ৪৫ থেকে ৫০ লাখ। এই লোহিত রক্ত ​​কণিকা লোহিত অস্থিমজ্জায় উৎপন্ন হয়, কিন্তু হিমোগ্লোবিনের অভাবে পুরো শরীর সঠিক পরিমাণে অক্সিজেন পায় না।হিমোগ্লোবিন অক্সিজেনের সাথে দ্রুত একত্রিত হয়ে অস্থায়ী যৌগ অক্সিহেমোগ্লোবিন গঠন করার ক্ষমতা রাখে। এটি শ্বাসতন্ত্রে ক্রমাগত অক্সিজেন সরবরাহ করে ব্যক্তিকে জীবন দেয়।

স্বাভাবিক ভাবে লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল হয় ১২০ দিন। কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিনের কারণে লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল অনেকটা কমে যায় এবং লোহিত কণিকা গুলো অল্প সময়ের মধ্যেই সহজে ভেঙে যায়। যার ফলে রোগীর শরীরে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।

থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ

থ্যালাসেমিয়া রোগের কিছু লক্ষণ নিচে দেওয়া হল –

  • মাথা ঘোরা
  • বসা থেকে উঠলে চোখে অন্ধকার দেখা
  • খাদ্যে অরুচি
  • সর্বদাই মনমরা ভাব
  • ক্লান্তি বোধ
  • স্বাভাবিক বিকাশে বিলম্ব
  • রক্তস্বল্পতা
  • মুখের হাড়ের বিকৃতি
  • ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়া
আরও পড়ুনঃ ফ্যাটি লিভার কি এবং ফ্যাটি লিভারের ডায়েট চার্ট

শিশুর থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ

এই রোগে আক্রান্ত শিশু জন্মগ্রহন করার পর থেকে ছয় মাসের মধ্যে ধীরে ধীরে ফ্যাকাসে হতে শুরু করে। কারণ একজন সুস্থ শিশুর ক্ষেত্রে যেখানে রক্তে ফিটাল হিমোগ্লবিনের পরিমাণ থাকে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ, সেখানে এই রোগে আক্রান্ত শিশুর জন্মানোর ছয়মাস পর থেকেই রক্তে হিমোগ্লবিনের মাত্রা কমতে কমতে শতকরা ২-৩ ভাগে এসে পৌঁছায়। যার ফলে শিশু রক্তশূন্য হয়ে পড়ে। এছাড়াও যে বয়সে শিশুর বসার কথা, দাঁড়ানোর কথা, কথা বলতে পারার কথা কিন্তু শিশুর এইধরনের স্বাভাবিক বিকাশ নিয়ম অনুযায়ী হয় না। শিশুর প্লীহা, অনেক সময় লিভার বড় হয়ে যায়, মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠে।

থ্যালাসেমিয়া কত প্রকার

থ্যালাসেমিয়াকে সাধারণত ২ ভাগে ভাগ করা হয় –

(১) আলফা থ্যালাসেমিয়া : যখন জিনে আলফা চেইনের সিনথেসিস সঠিকভাবে হয় না তখন জিনে অতিরিক্ত পরিমাণে বিটা বা গামা চেইন তৈরি হয়। যার ফলে আলফা থ্যালাসেমিয়া রোগের সৃষ্টি হয়।

(২) বিটা থ্যালাসেমিয়া: যখন বিটা চেইনের সিনথেসিস সঠিক ভাবে না হয় তখন গামা বা ডেল্টা চেইন অতিরিক্ত পরিমাণে তৈরি হয় । যার ফলে বিটা থ্যালাসেমিয়ার সৃষ্টি হয়।

থ্যালাসেমিয়ার কারণ কী – থ্যালাসেমিয়া কেন হয়

আমরা আগেই বলেছি যে থ্যালাসেমিয়া একটি জেনেটিক রোগ এবং মা বা বাবা বা উভয়ের জিনের ত্রুটির কারণে ঘটে। রক্তে হিমোগ্লোবিন 2 ধরণের প্রোটিন দিয়ে তৈরি – আলফা এবং বিটা গ্লোবিন। থ্যালাসেমিয়া ঘটে যখন জিনের মধ্যে একটি মিউটেশন ঘটে যা এই প্রোটিনগুলির মধ্যে একটি তৈরি করে।

যদি আপনার মা বা বাবার কারোরই জিনে মিউটেশন হয়ে থাকে, তাহলে আপনি যে থ্যালাসেমিয়া পাবেন তাকে থ্যালাসেমিয়া মাইনর বলে। এটি কোন উপসর্গ দেখায় না। কখনও কখনও কিছু লোকের মধ্যে যাদের থ্যালাসেমিয়া মাইনর সমস্যা আছে, তাদের হালকা লক্ষণ দেখা যায়।

যদি আপনার মা এবং আপনার বাবা উভয়ের জিনে মিউটেশন থাকে, তাহলে আপনার যে থ্যালাসেমিয়া হবে তাকে থ্যালাসেমিয়া মেজর বলা হয়। এটি একটি গৌণ রোগের চেয়ে আরও গুরুতর রোগ। তবে এই দুটি থ্যালাসেমিয়া যদি সময়মতো চিকিৎসা না করা হয় তবে এটি পরবর্তীতে মারাত্মক হতে পারে।

কিভাবে থ্যালাসেমিয়া নির্ণয় করা হয় – থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা

আপনার ডাক্তার যদি থ্যালাসেমিয়া নির্ণয় করার চেষ্টা করেন, তাহলে তারা প্রথমে আপনার রক্তের নমুনা নেবেন । রক্তাল্পতা এবং অস্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করার জন্য ডাক্তার এই নমুনা একটি পরীক্ষাগারে পাঠান। একজন ল্যাব টেকনিশিয়ান, একটি মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে আপনার রক্তের দিকে তাকাবেন এবং লাল রক্ত ​​কণিকার (RBCs) আকার খারাপ হয়েছে কিনা তা দেখার চেষ্টা করবেন।

যদি আপনার লোহিত রক্ত ​​কণিকার (RBC) আকার অস্বাভাবিক বলে মনে হয়, তাহলে এর মানে হল আপনার থ্যালাসেমিয়ার সমস্যা রয়েছে। উপরন্তু, ল্যাব টেকনিশিয়ান হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস নামে একটি পরীক্ষা করতে পারে। এই পরীক্ষার মাধ্যমে, লোহিত রক্তকণিকাগুলিকে একে অপরের থেকে আলাদা করা হয় যাতে অস্বাভাবিক ধরনের লোহিত রক্তকণিকা সহজেই শনাক্ত করা যায়।

থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসা

থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত শিশুর রক্ত যেহেতু হিমোগ্লোবিন বা লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদন করতে পারে না, তাই আক্রান্ত শিশুর রক্তে নিয়মিত হিমোগ্লোবিন দিতে হয়। রোগীর শরীরে প্রতি একুশ দিন পর পর এক থেকে দুই ইউনিট রক্ত দিতে হয়। এছাড়াও থ্যালাসেমিয়া রোগী যদি খাবারের সঙ্গে শতকরা পঞ্চাশ শতাংশ আয়রন গ্রহণ করে তাহলে তা হজম করতে পারে না। আর এই আয়রন শিশুর লিভার, প্লীহা, হার্ট, অগ্নাশয়ে জমে শিশুর শরীরে নানা ধরনের অসুখের তৈরি করে। যে সমস্ত খাবারে আয়রন আছে, যেমন : লাল মাংস, কলিজা ইত্যাদি খাবার থ্যালাসেমিয়া রোগীর খাওয়া উচিত নয়। এগুলোর পরিবর্তে ভাত, ডাল, সবজি, মাছ, দুধ ইত্যাদি খাওয়া উচিত। কারণ এইসব খাবার আমাদের শরীরে আয়রন জমতে দেয় না। তবে অনেক সময় ইঞ্জেকশন এর মাধ্যমে রোগীর শরীর থেকে জমে যাওয়া আয়রন বের করে নেওয়া হয়। তবে থ্যালাসেমিয়া রোগের কার্যকর কোন চিকিৎসা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। প্রতি একুশ দিন পর পর রক্ত দিয়েও একজন থ্যালাসেমিয়া রোগীকে খুব বেশী হলে পঁচিশ-ত্রিশ বছর পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখা যায়।

আরও পড়ুনঃ থাইরয়েড কী? থাইরয়েড রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার

থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে করণীয়

থ্যালাসেমিয়া রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা অত্যন্ত জরুরী। বিয়ের আগে নারী এবং পুরুষের রক্ত পরীক্ষা করে দুজন বাহকের মধ্যে বিয়ে এড়াতে পারলে থ্যালাসেমিয়ার হার অনেকাংশে কমানো সম্ভব। কারণ দুজন থ্যালাসেমিয়া বাহকের মিলিত সন্তানই শুধুমাত্র এই রোগের দ্বারা আক্রান্ত হয়। সুতরাং আপনার শিশুর ভবিষ্যৎ এর কথা চিন্তা করে বিয়ের পূর্বে টেস্ট করে নেওয়া উচিত। নিজের আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে নিরুৎসাহিত করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রে সন্তান গর্ভে আসার পর চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বিশেষ উপায়ে গর্ভস্থ শিশুর থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করা যায়।

থ্যালাসেমিয়া হলে আর কি কি সমস্যা হতে পারে?

থ্যালাসেমিয়ার কারণে আরও অন্যান্য সমস্যার তৈরি হতে পারে;

  • আয়রন ওভারলোড: থ্যালাসেমিয়ার কারণে আপনার শরীরে আয়রনের পরিমাণ বেশি হয়ে যায়, যার কারণে হার্টের সমস্যা, লিভার এবং কিডনির রোগ ইত্যাদি অনেক সমস্যা হতে পারে।
  • সংক্রমণ: থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংক্রমণের প্রবণতা বেশি। বিশেষ করে যদি আপনার প্লীহা অপসারণ করা হয়।
  • হাড়ের বিকৃতি: থ্যালাসেমিয়ার কারণে আপনার হাড় বিকৃত হয়ে যায় , যার কারণে আপনার মুখের হাড়ের আকৃতি বিকৃত হয়ে যায় । এই কারণে, আপনার হাড় দুর্বল হয়ে যায়, যার ফলে হাড় ভাঙ্গার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
  • বর্ধিত প্লীহা: প্লীহা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। আপনার যদি থ্যালাসেমিয়ার সমস্যা থাকে, তাহলে লোহিত রক্ত ​​কণিকা (Red Blood Cells [RBC]) সঠিকভাবে তৈরি হয় না। এই কারণে, প্লীহার আকার বৃদ্ধি পায় এবং এটি স্বাভাবিকভাবে কাজ করে না।
  • হার্টের সমস্যা: আপনার যদি থ্যালাসেমিয়ার মতো বিপজ্জনক রোগ থাকে, তাহলে আপনার কনজেস্টিভ হার্ট ফেইলিউরের মতো হার্টের সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে।

শেষ কথা

যখন কোন যুবক যুবতী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন তার ঠিক আগে দুজনেরই অথবা যে কোনো একজনের স্থানীয় থ্যালাসেমিয়ার পরামর্শ কেন্দ্রে গিয়ে রক্তের পেপার ইলেকট্রোফোরোসিস পরীক্ষা করানো উচিত। কারণ পাত্র অথবা পাত্রীর যে কোন একজন যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন তবে তাদের অনাগত সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু যদি পাত্র এবং পাত্রী দুইজনই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হন তাহলে অনাগত সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী। এমন পরিস্থিতিতে অনাগত সন্তানের কথা চিন্তা করে বিয়ে না করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

আজকের আর্টিকেলটি নিয়ে যে কোন ধরনের প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে কমেন্ট সেকশনে জানান।

ধন্যবাদ ।

Share on:
Avatar photo

Hello Friends, I am James harden, the founder of this site. This blog provides accurate and precise information on Technology, Banking, Insurance, Tips & Tricks, Online Earning, Computer troubleshooting and much more.

Leave a Comment