প্রস্রাব করার সময় জ্বালাপোড়া হওয়া বর্তমানে খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার। যাইহোক, কখনও কখনও এটি UTI অর্থাৎ মূত্রনালীর সংক্রমণ ( 1Trusted ) এর কারণে হতে পারে। আবার যারা পানি কম পান করেন তাদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়। প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া হওয়া আসলে কোনো রোগ নয়, রোগের উপসর্গ। এই সমস্যা নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। তবে পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে এই সমস্যা একটু বেশি দেখা যায়। এমন পরিস্থিতিতে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসার পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাসের দিকেও বিশেষ যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। এমতাবস্থায় আজকের এই আর্টিকেলে আমরা প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া কমানোর ঘরোয়া উপায় সম্পর্কে বলব। এছাড়াও প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া কমাতে কি ধরনের খাবার খাওয়া উচিত সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। তাই প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হলে কী খাবার খাবেন আর কী খাবেন না তা জানতে পুরো লেখাটি পড়ুন।
Table of Contents
প্রস্রাবে সংক্রমণ কেন হয় – প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া কেন হয়
প্রস্রাবে সংক্রমণ বা জ্বালাপোড়া অনেক কারনে হতে পারে। জরায়ুমুখের প্রদাহ, যোনিপথে ছত্রাক সংক্রমণ বা ক্ল্যামাইডিয়ার মতো জীবাণু সংক্রমণের কারণে অনেক সময় প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হয়ে থাকে। এ ছাড়া তলপেটে ব্যথা, মাসিকের ব্যথা, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, সাবান বা কসমেটিকস বা প্যাডে অ্যালার্জিসহ অনেক কারণে প্রস্রাবে সংক্রমণ বা জ্বালাপোড়া হতে পারে। সংক্রমণ বারবার হলে ডায়াবেটিস, কিডনি বা পাথর সমস্যা, মূত্রথলিতে কোনো সমস্যা আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখে নিন।
প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে সঠিক মেয়াদে ও সঠিক মাত্রায় সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করা উচিত। আর যাদের ঘন ঘন প্রস্রাবে সংক্রমণ হয়, তারা ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা নিতে পারেন।
প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া কমানোর ঘরোয়া উপায়
ছেলেদের থেকে মেয়েদেরকেই এই রোগে বেশী আক্রান্ত হতে দেখা যায়। কারণ মেয়েদের ইউরিথ্রা বা মূত্রনালী পায়ুর খুব কাছাকাছি অবস্থান করে যার ফলে মলদার দিয়ে নির্গত ব্যাকটেরিয়া খুব সহজেই মূত্রনালিতে প্রবেশ করতে পারে। এছাড়াও মেয়েদের মুত্রনালী ছোট হওয়ার কারণে ব্যাকটেরিয়া খুব সহজেই মুত্রথলিতে ও কিডনিতে গিয়ে ইনফেকশন ঘটাতে পারে। ইউরিন টেস্ট করার মাধ্যমে মূত্রনালির সংক্রমন বা ইউটিআই নির্ণয় করা যায়। কী ধরনের জীবাণুর সংক্রমণ হয়েছে সেই অনুযায়ী ডাক্তার আপনাকে এন্টিবায়োটিক সেবন করতে দেবেন। তবে এন্টিবায়োটিক-এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে যেমন- ডায়রিয়া, বমি, চুলকানি হওয়া ইত্যাদি। এই ধরনের সংক্রমণ প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে খুব দ্রুত সুস্থ হওয়া যায়।
১. প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন: যাদের ইউটিআই এর সমস্যা আছে তাদের প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা প্রয়োজন। বেশী পরিমাণে পানি পান করলে প্রস্রাবের চাপ বৃদ্ধি পায় এবং প্রস্রাবের সাথে শরীর থেকে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া বের হয়ে যায়।
২. বেকিং সোডা পান করুন: এক গ্লাস পানিতে এক চামচ বেকিং সোডা ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে সপ্তাহে একদিন সকাল বেলা পান করুন, এর ফলে প্রস্রাবের জ্বালা পোড়া অনেকটা কমবে ।
৩. সেলারি বীজ চিবান: সেলারি বীজ মূত্র বর্ধক হিসাবে খুব ভাল কাজ করে। সেলেরি বীজ ভাল করে চিবিয়ে রস খেতে পারেন অথবা এক কাপ গরম পানিতে কিছু সেলেরি বীজ দিয়ে ৮ মিনিট রেখে দিন । পরে মিশ্রণটি পরিষ্কার কাপড়ের মাধ্যমে ছেঁকে নিয়ে পান করুন। এটা ইউটিআই প্রতিরোধ করতে খুব ভাল কাজ করে।
৪. শসা খান: শসাতে প্রচুর পরিমাণে পানি রয়েছে। প্রতিদিন খাবারের সাথে শসা সালাদ হিসেবে খেতে পারেন অথবা শসা স্লাইস করে কেটে খেতে পারেন।
৫. গরম সেঁক নিন: হট ওয়াটার ব্যাগ এ উষ্ণ গরম পানি নিয়ে আপনার তলপেটের উপরে রাখুন । এর ফলে খুব দ্রুত আপনার প্রস্রাবের জ্বালা পোড়া ও ব্যথা দূর হবে।
৬. আরামদায়ক পোশাক পড়ুন: স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় ব্যাকটেরিয়া বেশী জন্মায়। তাই নিয়মিত সূতির অন্তর্বাস পরলে ও ঢিলেঢালা পোশাক পরলে স্পর্শকাতর অঙ্গ গুলিতে ব্যাকটেরিয়ার জন্মাতে পারে না।
৭. এক চা চামচ জিরার গুড়া, আদার রস দুই চা চামচ এবং হাফ কাপ গরম পানি একসাথে ভালোভাবে মিশিয়ে প্রতিদিন পান করুন। আদায় রয়েছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্লমেটরি উপাদান যা প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া কমাতে খুব ভাল কাজ করে। অন্যদিকে, জিরার গুড়াতে থাকে কিউমিনালডিহাইড নামে একটি এনজাইম, যা ভেজাইনার প্রদাহ এবং ফোলাভাব কমাতে কার্যকরী ভুমিকা পালন করে।
আরও পড়ুনঃ স্ট্যামিনা কি এবং কিভাবে স্ট্যামিনা বাড়ানো যায়?
প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হলে কী খাবেন?
UTI-এর চিকিৎসার পাশাপাশি দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য খাদ্যাভ্যাসের যত্ন নেওয়াও অত্যন্ত প্রয়োজন। এমন পরিস্থিতিতে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হলে কী ধরনের খাবার খাবেন সে সম্পর্কে আমরা এখানে তথ্য দিচ্ছি। প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া রোধ বা কমানোর জন্য কিছু খাবার নিম্নরূপ:
1. ক্র্যানবেরি
মূত্রনালীর সংক্রমণ, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হওয়ার অন্যতম কারণ । এমন পরিস্থিতিতে মূত্রনালীর সংক্রমণ রোধ করতে বা এর উপসর্গ কমাতে ক্র্যানবেরি অর্থাৎ গুজবেরি খুব উপকারী । ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে, ক্র্যানবেরি বা ক্র্যানবেরি জুস মূত্রনালীর সংক্রমণ থেকে রক্ষা করার পাশাপাশি, এর লক্ষণগুলিও কমাতে পারে ( তথ্যসূত্র )।
একই সময়ে, অন্য একটি গবেষণা থেকে জানা যায় যে, ক্র্যানবেরি জুসে উপস্থিত প্রোঅ্যান্ট্রোসায়ানিডিন নামক যৌগটি মূত্রনালীর সংক্রমণের কারণ ব্যাকটেরিয়াগুলি ধ্বংস করতে কার্যকরী ভুমিকা পালন করে। সেক্ষেত্রে প্রস্রাবের জ্বালাপোড়ার সমস্যা দূর করতে ক্র্যানবেরি বা ক্র্যানবেরি জুস খাওয়া উপকারী।
2. প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার
প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হলে দই খেলে ভাল উপকার পাওয়া যায়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে , দই হল প্রোবায়োটিক খাবারের শ্রেণীভুক্ত, যা মূত্রনালীর সংক্রমণ প্রতিরোধে খুব ভাল কাজ করে।
3. প্রচুর পানি পান করুন
প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা, প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া থেকে মুক্তি দিতে ভাল কাজ করে। NCBI-এর একটি গবেষণায়, UTI-এর সমস্যায় বেশি বেশি পানি পান করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ( তথ্যসূত্র )। এমতাবস্থায় বলা যায় যে, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়ার ক্ষেত্রে বেশী পরিমাণ পানি পান করা উচিত।
4. ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার
ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার প্রস্রাবের জ্বালাপোড়ার সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। প্রকৃতপক্ষে, ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া নিয়ন্ত্রণ করে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভিটামিন সি উপকারী ভুমিকা পালন করে। এ সংক্রান্ত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতি ঘণ্টায় দুই গ্রাম ভিটামিন সি খেলে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়ার সমস্যায় উপকার পাওয়া যায় ( তথ্যসূত্র )।
ভিটামিন সি যুক্ত ব্লুবেরির জুস খেলে শরীর থেকে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া দূর হয়। সেই সাথে, এটি আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করতে পারে এবং ইউটিআই সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া থেকে রক্ষা করতে পারে। এর ভিত্তিতে, এটা বলা যেতে পারে যে, লেবু, কমলা, কিউই, ব্রকলির মতো ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা মূত্রনালীর সংক্রমণ বা প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া কমাতে উপকারী ভুমিকা পালন করে।
5. রসুন
প্রস্রাবে জ্বালাপোড়ার সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে রসুনকে খুবই উপকারী বলে মনে করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, রসুনের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। এগুলোর পাশাপাশি রসুনে সালফার যৌগ রয়েছে, যা শরীরকে ডিটক্সিফাই করতে সহায়ক ভুমিকা পালন করে। এই বৈশিষ্ট্যগুলি প্রস্রাব সংক্রমণের বিভিন্ন লক্ষণ, যেমন ঘন ঘন প্রস্রাব, ব্যথা বা জ্বালাপোড়া থেকে মুক্তি দিতে খুব ভাল কাজ করে ( তথ্যসূত্র )।
6. টাটকা ফল এবং সবজি
তাজা ফল ও শাকসবজি প্রতিদিন খেলে প্রস্রাবের জ্বালাপোড়ার সমস্যা অনেকাংশে কমে যায়। একটি গবেষণায়, এটি স্পষ্টভাবে দেখা গেছে যে, যারা সবুজ এবং শাক সবজি এবং তাজা ফল নিয়মিত খান তাদের মধ্যে প্রস্রাব সংক্রমণের লক্ষণগুলি কম দেখা যায়। এমন পরিস্থিতিতে বলা যেতে পারে যে তাজা ফল ও শাক-সবজি খাওয়া মূত্রনালীর সমস্যা বা মূত্রনালীর সংক্রমণ বা প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া প্রতিরোধে কার্যকরী ভুমিকা পালন করে ( তথ্যসূত্র )।
আরও পড়ুনঃ সকালে হাটা বা মর্নিং ওয়াকের উপকারিতা
প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হলে কী খাওয়া উচিত নয়
প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হলে নিচে উল্লেখিত খাবারগুলো এড়িয়ে চলতে হবে –
- ক্যাফিনযুক্ত পানীয়
- অ্যালকোহল
- কার্বনেটেড পানীয়
- মিষ্টি পানীয়
- আমিষ জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন।
শেষ কথা
এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হওয়ার কারণ, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হলে কী খাবেন এবং কি খাবেন না সে সম্পর্কে তথ্য জানানোর চেষ্টা করেছি। তবে এখানে উল্লেখিত খাবার খাওয়ার আগে অবশ্যই একবার চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া ভালো। সেই সাথে, আপনি প্রস্রাবের জ্বালাপোড়ার জন্য ডায়েট সম্পর্কিত ডায়েট চার্ট সম্পর্কেও আপনার ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। তবে, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের ওষুধ ব্যবহার করবেন না। সেই সঙ্গে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া এড়াতে বা কমাতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে খেয়াল রাখুন। মনে রাখবেন, সতর্কতাই এই সমস্যা এড়াতে সবচেয়ে সহজ এবং ভালো উপায়।
আর্টিকেলটি নিয়ে যে কোন ধরনের প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে কমেন্ট সেকশনে জানান
ধন্যবাদ