প্রায়ই যে কোন জিনিস ভুলে যাওয়া, একই জিনিস বার বার পুনরাবৃত্তি করা বা কোনও বিষয়ে আগ্রহ না দেখানো, ইত্যাদি বিষয়গুলো অটিজমের কারণে হতে পারে । এটি এক ধরনের মানসিক রোগ, যা শৈশবে শুরু হয় । তাই সময়মতো অটিজমের চিকিৎসা শুরু করা গুরুত্বপূর্ণ, অন্যথায় এর পরিণতি পরবর্তীতে মারাত্মক হতে পারে ( তথ্যসূত্র ) । আজকের এই আর্টিকেলে আমরা আপনাদের সাথে, অটিজম কি ? অটিজমের কারণ, লক্ষণ এবং ঘরোয়া প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করব ।
Table of Contents
অটিজম কি – অটিজম কাকে বলে
অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার হল এক প্রকার মানসিক রোগ । জীবনের প্রথম দিকে অর্থাৎ শিশু অবস্থায় এর লক্ষণগুলি দেখা দিতে শুরু করে । এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি বা শিশু সামাজিক, যোগাযোগ এবং আচরণগত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে । এটি এক ধরনের নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার, যা বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়তে থাকে । কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে, অটিজম বলতে অন্যান্য মানসিক ব্যাধিও বোঝাতে পারে , তবে এটি শুধুমাত্র বিরল পরিস্থিতিতে ঘটে ( তথ্যসূত্র )।
আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের মতে, এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির মানুষদের কথা বলতে বা ব্যাখ্যা করতে সমস্যা হয়, যা তার দৈনন্দিন জীবনে অর্থাৎ স্কুল, অফিস বা জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে ।
বিশ্ব অটিজম দিবস কত তারিখ – বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস কবে
বিশ্ব অটিজম দিবস হল ২ এপ্রিল বা বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস হল ২ এপ্রিল
অটিজমের প্রকার – অটিজম কত প্রকার
অটিজমের সমস্যাকে সাধারণত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় –
অটিস্টিক ডিসঅর্ডার: অটিস্টিক ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত শিশু বা ব্যক্তিদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা দেখা যায় । এই ধরনের মানুষদের, অন্যদের সাথে কথা বলতে এবং সামাজিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে সমস্যা হয় । সেই সাথে তাদের আচরণ ও আগ্রহের পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায় ।
অ্যাসপারজার সিনড্রোম: অ্যাসপারজার সিনড্রোমের লক্ষণগুলো অটিস্টিক ডিজঅর্ডারের মতো স্পষ্ট নয় । এই ধরনের অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে আগ্রহের কমতি দেখা যায় এবং সামাজিক যোগাযোগেও সমস্যা হয় । অটিস্টিক ডিসঅর্ডারের মতো, ভাষা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা এই ধরণের মধ্যে তেমন একটা দেখা যায় না ।
Pervasive Developmental ডিসঅর্ডার: অটিজমের এই ধরনেরটিকে, অ্যাটিপিকাল অটিজমও বলা হয় । এই ধরনের অটিজমের লক্ষণ অটিস্টিক ডিসঅর্ডারের মতো হতে পারে । যদিও সব উপসর্গ এক রকম নয়, তবে এই ধরনের অটিজমের ক্ষেত্রে, সামাজিক আচরণে এবং যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় সমস্যা হতে পারে ।
আরও পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় কোন ফল খাওয়া উচিত এবং কোনটি উচিত নয়
অটিজমের কারণ – অটিজম কেন হয়
অটিজমের সঠিক কারণ এখনও সম্পূর্ণরূপে জানা যায়নি, তবে এটি জেনেটিক কারণেও হতে পারে, আবার পরিবেশগত কারণেও হতে পারে ( তথ্যসূত্র )। অটিজমের কারণগুলি নিচে উল্লেখ করা হল –
গর্ভকালীন বয়স: ৩৪ বা তার বেশি বয়সে মা হওয়া
গর্ভাবস্থায় জটিলতা: গর্ভাবস্থায় ভাইরাল সংক্রমণ, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, রক্তপাত, ডায়াবেটিস বা জরায়ুতে অক্সিজেনের অভাব এগুলোর কারণেও শিশু অটিজমে আক্রান্ত হতে পারে ।
গর্ভবতীর মানসিক স্বাস্থ্য: গর্ভকালীন সময়ে, মহিলারা যদি সিজোফ্রেনিয়া, বিষণ্ণতা এবং দুশ্চিন্তায় ভুগে থাকেন, তাহলে অনাগত সন্তানের অটিজমে আক্রান্ত হওয়া ঝুঁকি বেড়ে যায় ।
গর্ভাবস্থায় ওষুধ : গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত মাত্রায় ওষুধ সেবনের কারণে, অটিজমের ঝুঁকি ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায় ।
পারিবারিক পরিস্থিতি: পরিবারের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতি শিশুর অটিজম সমস্যাকে প্রভাবিত করে ।
অটিজমের লক্ষণ – অটিজমের উপসর্গ
অটিজমের শীর্ষ লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ করতে সমস্যা হওয়া, একই বিষয় বার বার পুনরাবৃত্তি করা এবং আগ্রহ হ্রাস । তবে অটিজমের উপসর্গ সবার মধ্যে একরকম দেখা যায় না । নিচে কিছু কমন লক্ষণ উল্লেখ করা হল, যা অটিজমে আক্রান্ত বেশিরভাগ ব্যক্তি বা শিশুর মধ্যে দেখা যায় –
সামাজিক যোগাযোগের সমস্যা যেমন –
- সামান্য বা একেবারেই চোখে চোখ রেখে কথা বলবে না ।
- অন্যের কথা শুনবে না ।
- নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেবে না ।
- যোগাযোগ বজায় রাখতে সমস্যা ।
- অন্য ব্যক্তিকে সুযোগ না দিয়ে, নিজের আগ্রহের বিষয় নিয়ে অনেক কথা বলা ।
- শারীরিক মুভমেন্ট, যা বলা হচ্ছে তার সাথে মেলে না ।
- গান গাওয়া বা অস্বাভাবিক আওয়াজ করা, যা কথা বলার সময় অনেকটা রোবটের মতো শোনায় ।
- অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে বা তাদের মুভমেন্ট বুঝতে সমস্যা হওয়া ।
সীমাবদ্ধ/পুনরাবৃত্তি আচরণ যেমন –
- অস্বাভাবিক উপায়ে শব্দ করা এবং একই জিনিস পুনরাবৃত্তি করা ।
- সংখ্যা বা তথ্যের মতো নির্দিষ্ট বিষয়ে অনেক বেশী আগ্রহী হওয়া ।
- দৈনন্দিন জীবনে সামান্য পরিবর্তন নিয়েও বিষণ্ণ হওয়া ।
- আলো, শব্দ, তাপমাত্রার বা পোশাকের প্রতি অন্যদের তুলনায় বেশি সংবেদনশীল হওয়া ।
অটিজমের লক্ষণগুলির মধ্যে কিছু ইতিবাচক জিনিসও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যেমন –
- দীর্ঘ সময় ধরে কোন বিস্তারিতভাবে জিনিস মনে রাখতে সক্ষম ।
- যে কোন জিনিস দেখে বা শুনে সহজে শিখতে পারে এবং মনে রাখতে পারে ।
- গণিত, বিজ্ঞান, সঙ্গীত বা শিল্পকলায় অনেক বেশী দক্ষতা অর্জন করতে পারে ।
অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে নিচের লক্ষণগুলো দেখা যায় –
- অন্যান্য শিশুদের সাথে না মেশা
- একা থাকা
- খেলাধুলায় অংশগ্রহণ না করা বা আগ্রহ না দেখানো
- চুপচাপ এক জায়গায় ঘন্টার পর ঘন্টা এক বসে থাকা,
- একই বস্তুর উপর ফোকাস করা
- অন্যদের সাথে যোগাযোগ না করা
- ভিন্নভাবে কথা বলা, যেমন তৃষ্ণার্ত হলে ‘আমি পানি খেতে চাই’ বলার পরিবর্তে ‘তুমি কি পানি খাবে’
- কথোপকথনের সময় অন্য ব্যক্তি যা বলেছে তার পুনরাবৃত্তি করা
- পাগলামি করা
- নিজেকে আঘাত করা বা ক্ষতি করার চেষ্টা
- রাগান্বিত, নার্ভাস, অস্থির ভাব এবং নাশকতার মতো আচরণ করা
- হাততালি বা হাততালির মতো কিছু একটানা করে যাওয়া
- একই বাক্য বারবার রিপিট করা
- অন্য মানুষের অনুভূতি বুঝতে অক্ষমতা
- অন্যের পছন্দ-অপছন্দ বুঝতে অক্ষমতা
- কিছু শব্দ, স্বাদ এবং গন্ধে অদ্ভুতভাবে রিয়্যাক্ট করা
- পুরানো দক্ষতা ভুলে যাওয়া
অটিজমের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে সঠিক সময়ে চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন । তবে চিকিৎসা গ্রহনের পাশাপাশি অটিজমের ঘরোয়া প্রতিকারগুলো অবলম্বন করা যেতে পারে । আর্টিকেলের পরবর্তী অংশে অটিজমের ঘরোয়া প্রতিকারগুলো দেওয়া হল ।
অটিজমের সাথে যুক্ত অন্যান্য সমস্যা
অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাধারণত নিম্নলিখিত সমস্যাগুলি দেখা দিতে পারে –
- ডিসলেক্সিয়া: এই ধরনের ব্যক্তিদের চিঠি লিখতে এবং পড়তে সমস্যা হয়।
- ডিসপ্র্যাক্সিয়া : এই সমস্যায় ভুগছেন এমন ব্যক্তিদের, অন্যদের দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী কাজ কমপ্লিট করতে অসুবিধা হয় ।
- অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার: এই অবস্থায় মানুষ সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে যায় এবং কোন বিষয়ে ফোকাস করতে সমস্যা হয় । এই ধরনের ব্যক্তি বা শিশুদের স্কুলে এবং কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে ।
- অনিদ্রা: এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি অনিদ্রা সমস্যায় ভুগতে পারেন ।
- শেখার অক্ষমতা: এতে ব্যক্তি বা শিশুর নতুন জিনিস শিখতে, নতুন কোন তথ্য বুঝতে এবং নিজের যত্ন নিতে অসুবিধা হয় ।
- মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা: অটিজম রোগীদের মধ্যে অস্থিরতা (অধিকাংশ সময় উদ্বিগ্ন থাকা), অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার দেখা যায় । এই ধরনের ব্যক্তিরা সবসময় বিষণ্নতা (হতাশা এবং দুঃখ) অনুভব করেন ।
- জয়েন্টে ব্যথা: কিছু অটিস্টিকে আক্রান্ত ব্যক্তি তাদের জয়েন্ট এবং হাঁটুতে ব্যথা অনুভব করে ।
- কোষ্ঠকাঠিন্য: কোষ্ঠকাঠিন্য এবং ডায়রিয়ার মতো সমস্যা অটিজমে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে দেখা যায় ।
অটিজমের ঘরোয়া প্রতিকার
নীচে উল্লিখিত ঘরোয়া প্রতিকারগুলি অটিজমের লক্ষণগুলি কিছুটা কমাতে সহায়তা করতে পারে । অটিজমের সমস্যা কমাতে ঘরোয়া প্রতিকার কীভাবে কাজ করে এবং কীভাবে সেগুলি ব্যবহার করবেন তা নিচে দেওয়া হল –
ইপসম সল্ট – একটি বালতিতে হালকা গরম পানি নিয়ে তাতে দুই কাপ ইপসম সল্ট এবং আধা কাপ বেকিং সোডা ভালোভাবে মিশিয়ে নিন । এরপর আপনার শিশুকে সেই পানিতে প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট বসিয়ে রাখুন । তারপর পরিষ্কার পানি দিয়ে ভাল করে গোসল করান । অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে বেশীরভাগ সময় কম পরিমাণে প্লাজমা সালফেট (রক্তে সালফেটের মাত্রা) থাকে, যে কারণে চিকিৎসকরা তাদের সালফেট সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন । শরীরে প্লাজমা সালফেটের মাত্রা বাড়ানোর একটি কার্যকর উপায় হল Epsom সল্টের মাধ্যমে গোসল করা । সেই সাথে বেকিং সোডার কারণে শরীর বেশী পরিমাণে লবণ শোষণ করতে পারে । এইভাবে অটিজমের ঘরোয়া প্রতিকার হিসেবে ইপসম লবণ ব্যবহার করা যেতে পারে ।
ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিড – ডাক্তারের পরামর্শে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট দেওয়া যেতে পারে ।
অটিজমের ঘরোয়া প্রতিকার হিসেবে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার গ্রহন করা যেতে পারে । NCBI ( ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন ) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, শরীরে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের ঘাটতির কারণে অটিজমের সমস্যা হতে পারে । ওমেগা-৩ হল এক ধরনের পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড । এটি মানুষের মস্তিষ্কের কোষের ঝিল্লিকে সঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করতে পারে । এছাড়াও, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, অটিজমের কিছু লক্ষন যেমন- মানসিক এবং আচরণগত সমস্যা কমাতে সাহায্য করতে পারে ।
প্রোবায়োটিক – চিকিৎসকরা অটিজমের রোগীকে অনেক সময় প্রোবায়োটিক সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন । প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার রোগীর প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন । অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়ই পেট সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় ভোগেন, যেমন- পেটে ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং ডায়রিয়া । যা তাদের অস্বাভাবিক আচরণের অন্যতম একটি কারণ হতে পারে । এমন অবস্থায়, প্রোবায়োটিক-সমৃদ্ধ খাবার এবং সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা রোগীর জন্য উপকারী হতে পারে । প্রোবায়োটিকগুলি মানুষের অন্ত্রে ভাল এবং খারাপ ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে, পেটের বিভিন্ন সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে সাহায্য করতে পারে ।
যেকোনো রোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে, এর চিকিৎসার পাশাপাশি সঠিক খাদ্যাভ্যাস গ্রহণ করাও জরুরী । আর্টিকেলের পরবর্তী অংশে জেনে নেয়া যাক অটিজমের জন্য কী ধরনের খাদ্য গ্রহণ করা উচিত ।
আরও পড়ুনঃ বদহজমের কারণ, লক্ষণ এবং ঘরোয়া প্রতিকার
অটিজমের জন্য ডায়েট
অটিজম থেকে মুক্তি পেতে নিম্নোক্ত খাবারগুলো রোগীর প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে –
ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্য: অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে প্লাজমা ম্যাগনেসিয়ামের পরিমাণ কম থাকে, যা অটিজমের লক্ষণগুলির অন্যতম একটি কারণ হতে পারে । শরীরে ম্যাগনেসিয়ামের অভাবে মানসিক অস্থিরতা দেখা যায় ( তথ্যসূত্র ) । এই জন্য, রোগীর খাদ্যতালিকায় ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার অন্তর্ভুক্ত করা উচিত –
- ফল যেমন কলা, অ্যাভোকাডো ইত্যাদি
- বাদাম যেমন চিনা বাদাম বা কাজু বাদাম
- ছোলা
- সয়াবিন
- দুধ
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার: আমরা আর্টিকেলের আগের অংশে উল্লেখ করেছি যে, অটিজমের অন্যতম কারণ হল শরীরে ওমেগা-৩-এর অভাব । এমন অবস্থায়, আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতিদিনের ডায়েটে ওমেগা – ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার অন্তর্ভুক্ত করে অটিজমের লক্ষণগুলি কমানো যেতে পারে ( তথ্যসূত্র ) । নিচে উল্লেখিত খাবারগুলি ওমেগা -3 ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ –
- স্যামন, টুনা, ট্রাউট এবং সার্ডিন জাতীয় মাছ
- শণ বীজ এবং তেল
- আখরোট
- চিয়া বীজ
- ক্যানোলা এবং সয়া তেল
- সয়াবিন
প্রোবায়োটিক-সমৃদ্ধ খাদ্য: রোগীর খাদ্যে প্রোবায়োটিক-সমৃদ্ধ খাদ্য যোগ করাও অটিজমের জন্য উপকারী হতে পারে, যা অটিজমের কারণে হওয়া পেটের সমস্যা কমাতে সাহায্য করতে পারে । প্রোবায়োটিকের জন্য নিম্নলিখিত খাবারগুলি রোগীর খাবারে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে –
- পনির
- বাটারমিল্ক
- দই
- আইসক্রিম
- গুঁড়া দুধ
- গাঁজানো দুধ
অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারে যে খাবারগুলি খাওয়া উচিত তা জানার পরে, এখন আমরা জানব কোন খাবারগুলি খাওয়া উচিত নয় ।
- গম
- বার্লি
- রাই
- গ্লুটেন সমৃদ্ধ খাবার
- রুটি এবং অন্যান্য বেকড পণ্য
- পাস্তা
- সয়া সস
- অতিরিক্ত ভাজা খাবার
- হিমায়িত খাবার, স্যুপ
- সস
- মিছরি
- কিছু ওষুধ এবং ভিটামিন
অটিজমের চিকিৎসা
সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এর তথ্য অনুসারে, সরাসরি অটিজমের চিকিৎসা করতে পারে এমন কোনো ওষুধ এখনও পর্যন্ত নেই । তাই, চিকিৎসকরা, আক্রান্ত ব্যক্তিকে এমন ধরনের ওষুধ গ্রহনের পরামর্শ দেন, যা অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে সাহায্য করতে পারে । যেমন বিষণ্ণতা কমানোর ওষুধ অথবা মনোযোগের সমস্যা থেকে মুক্তি দেওয়ার ওষুধ ইত্যাদি । চিকিৎসকরা কিছু ওষুধের মাধ্যমে অটিজমের লক্ষণগুলি কমিয়ে চিকিৎসা করে থাকেন –
আচরণ এবং যোগাযোগের পদ্ধতিঃ এতে আক্রান্ত ব্যক্তির সামাজিক যোগাযোগ এবং বিহ্যাবিয়ারের উপর কাজ করা হয় । এতে এমন থেরাপি দেয়া হয়, যেখানে রোগীকে পোশাক, খাওয়া, গোসল, ডাক বা স্পর্শে সাড়া দেওয়া, কথা বলার ধরন নিয়ন্ত্রণ করা এবং মানসিক আচরণ ইত্যাদি বিষয় শেখানো হয় ।
ডায়েটারি থেরাপিঃ এতে অটিজমের লক্ষন কমাতে, আক্রান্ত ব্যক্তির খাবারে ভিটামিন ও মিনারেল সাপ্লিমেন্ট যুক্ত করা হয় । একই সাথে সেই সব পুষ্টি উপাদান রোগীর ডায়েটে যোগ করা হয়, যেগুলোর অভাব আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে থাকে । এই থেরাপিতে রোগীর প্রতিদিনের খাবারে পরিবর্তন আনা হয় ।
পরিপূরক এবং বিকল্প চিকিৎসাঃ এই থেরাপি খুব কমই ইউজ করা হয় । এতে রোগীর খাদ্যতালিকায় বিশেষ ধরনের খাবার অন্তর্ভুক্ত করা হয় । সেই সাথে, চিলেশনের মতো একটি প্রসেস (শরীর থেকে সীসার মতো ধাতু অপসারণের প্রক্রিয়া)ও এই থেরাপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে ।
অটিজমে জীবনধারা
জীবনধারার কিছু পরিবর্তন অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জন্য সহায়ক ভুমিকা পালন করতে পারে ।
1. শিশুদের সাথে যোগাযোগ সহজতর করুন
- বাচ্চাদের সাথে ধীরে ধীরে নিচু স্বরে এবং পরিষ্কারভাবে কথা বলুন
- সহজে বোঝা যায় এমন শব্দ ইউজ করুন
- সন্তানের সাথে কথা বলার সময় বার বার শিশুর নাম পুনরাবৃত্তি করুন । যাতে আপনার শিশু বুঝতে পারে যে, আপনি তার সাথে কথা বলছেন ।
- শিশুকে আপনার কথা বুঝতে এবং তারপর প্রতিক্রিয়া জানাতে যথেষ্ট সময় দিন
- কথোপকথনের সময় হাতের সাহায্যে অঙ্গভঙ্গি করুন এবং আপনি চাইলে ছবির সাহায্যও নিতে পারেন
2. খাবার শেখান
অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে খাওয়া-দাওয়া করতে চায় না এবং শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট রঙ বা ধরনের খাবার খায় । এছাড়াও তাদের খাবার আটকে যাওয়া বা খাওয়ার সময় কাশি হওয়ার সমস্যাও হতে পারে । এই অবস্থায়, পিতামাতার উচিত তাদের সন্তানের প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাস একটি ডায়েরিতে লিখে রাখা । এর ফলে তারা শিশুর সমস্যাগুলি বুঝতে পারবে এবং সেগুলি এড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে । সেই সাথে শিশুর খেতে সমস্যা হওয়ার বিষয়টি নিয়ে আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলুন এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহন করুন ।
3. যখন শিশুর ঘুমাতে সমস্যা হয়:
একটি ডায়েরিতে আপনার শিশুর ঘুমানোর সময় এবং জেগে ওঠার সময় নোট করুন এবং সমস্যাটি বোঝার চেষ্টা করুন ।
- শিশুর ঘরটি শান্ত এবং অন্ধকার হওয়া উচিত ।
- শিশুর ঘুম থেকে ওঠার সময় নির্ধারণ করুন ।
- প্রয়োজনে শিশুকে ইয়ারপ্লাগ পরতে দিন ।
4. আবেগ নিয়ন্ত্রণ শেখান
কিছু কিছু শিশু তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না এবং প্রায়ই কাঁদে । এই ধরনের শিশুদের সাহায্য করার জন্য, পিতামাতার নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহন করা উচিত –
- ডায়েরিতে এমন জিনিস বা ঘটনা গুলো লিখে রাখুন যার পরে শিশুটি কাঁদতে শুরু করে
- শিশুর ঘর থেকে চটকদার আলো এবং বাল্ব সরিয়ে ফেলুন ।
- শিশুকে মিষ্টি এবং আরামদায়ক সঙ্গীত শুনতে দিন ।
- শিশুর রুটিনে কোনো পরিবর্তন করার আগে তাকে সে বিষয়ে অবহিত করুন ।
5. পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব শেখান
পিতামাতাদের অবশ্যই তাদের সন্তানদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার গুরুত্ব বোঝাতে হবে । শিশুকে তাদের নিজেদেরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে শেখান এবং এর জন্য দিনের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে দিন ।
6. আরামদায়ক হতে সাহায্য করুন
কিছু কিছু শিশু খুব বেশী আবেগপ্রবণ এবং সংবেদনশীল হয় । এই ধরনের শিশুরা অতিরিক্ত ভিড়, শব্দ এবং উজ্জ্বল আলো দেখে ভয় পায় । এই ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে এই ধরনের শিশুদের অভিভাবকদের নিচে উল্লেখিত বিষয়গুলি মাথায় রাখা উচিত –
- যদি আপনার সন্তানের আওয়াজের কারণে সমস্যা হয়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী তাকে শব্দ কমানোর হেডফোন বা ইয়ারপ্লাগ ইউজ করতে দিন ।
- শিশুর সাথে কথা বলার সময়, তাকে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্য সময় দিন । এরপরও শিশুটি না বুঝলে পুনরায় বোঝানোর চেষ্টা করুন । কিন্তু উচ্চস্বরে কথা বলে তার সাথে রাগারাগি করবেন না ।
- শিশু যদি কোন জায়গায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ না করে, তাহলে অভিভাবকের উচিত তাকে সেইসব জায়গায় কম নিয়ে যাওয়া । এবং সেই জায়গায় যখন খুব বেশি ভিড় না থাকে তখন নিয়ে যাবেন । তারপরে, ধীরে ধীরে শিশুকে সেখানে থাকার পরিমাণ বাড়াতে থাকেন । মূল কথা হল শিশুকে জোড় করে কোন জায়গায় রাখার চেষ্টা করবেন না ।
- শিশুর আবেগকে কন্ট্রোল করার জন্য একটি শান্ত পরিবেশ তৈরি করুন ।
অটিজম এড়ানোর প্রতিকার – অটিজম প্রতিরোধের টিপস
অটিজম এড়ানোর জন্য গর্ভকালীন সময়ে কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে । অটিজম প্রতিরোধের কিছু টিপস নিচে দেওয়া হল –
- গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ, অনাগত শিশুর অটিজমের ঝুঁকি অনেকাংশে কমাতে পারে ( তথ্যসূত্র )।
- ভ্রূণের নিউরাল টিউব ত্রুটি নির্ণয় করার জন্য নুচাল ট্রান্সলুসেন্সি (এনটি) এবং ট্রিপল মার্কার টেস্ট করা যেতে পারে । এই টেস্টের সাহায্যে, শিশুর এই ধরনের সমস্যা হওয়ার আগেই প্রতিরোধ করা সম্ভব ( তথ্যসূত্র )।
- গর্ভাবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতিত অন্য কোন ধরনের ওষুধ খাবেন না ।
- আপনার শিশুর জন্মের পর নিয়মিত টেস্ট করান এবং টিকা দিন ।
শেষ কথা
আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা আপনাদের সাথে, অটিজম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি ।বেশীরভাগ ক্ষেত্রে অটিজমের লক্ষণগুলির কারণে, এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়শই তাদের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন । তাই যত দ্রুত সম্ভব তাদের সঠিকভাবে চিকিৎসা করানো গুরুত্বপূর্ণ । অটিজমের জন্য সঠিক সময়ে চিকিৎসা, থেরাপি এবং ঘরোয়া প্রতিকারের সাহায্যে এর লক্ষণগুলি অনেকাংশে হ্রাস করা যেতে পারে । এটি একজন ব্যক্তিকে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে যেতে সাহায্য করতে পারে । তবে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে অটিজমের চিকিৎসা করানো উচিত । আর্টিকেলটি নিয়ে যে কোন ধরনের প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে কমেন্ট সেকশনে জানান । ধন্যবাদ