প্রায় সব বাড়িতেই খাবারের স্বাদ এবং গন্ধ বাড়ানোর জন্য জিরা ব্যবহার করে । বাড়িতে ব্যবহৃত জিরা ছাড়াও আরও এক ধরনের জিরা রয়েছে, যা কালোজিরা নামে পরিচিত । কালোজিরা অনেক ধরনের ঔষধি গুণে ভরপুর । কালোজিরার কী বিশেষত্ব রয়েছে এবং কেন কালোজিরাকে এত ভাল বলে মনে করা হয় তা জানতে আর্টিকেলটি পড়ুন । আজকের এই আর্টিকেলে আমরা আপনাদের সাথে কালোজিরার উপকারিতা, ব্যবহার এবং অসুবিধা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব । আজকের আর্টিকেলে উল্লেখিত সকল তথ্য, বৈজ্ঞানিক গবেষণার উপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়েছে ।
Table of Contents
কালোজিরার উপকারিতা
বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণার উপর ভিত্তি করে কালোজিরার কিছু উপকারিতা নিচে দেওয়া হল –
হজমের জন্য – কালোজিরা আমাদের হজম শক্তি বৃদ্ধি করতে সহায়ক ভুমিকা পালন করে । NCBI (ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন) এর সাইটে প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুসারে, কালোজিরা বিভিন্ন সমস্যার জন্য একটি ঐতিহ্যগত প্রতিকার হিসাবে কাজ করে, যার মধ্যে একটি হল হজম । এটি হজমে সহায়তা করার পাশাপাশি, পরিপাকতন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যাগুলি কমাতে খুব ভাল কাজ করে । গবেষণায় আরও বলা হয়েছে যে, কালোজিরা মিশ্রিত পানি পান করলে বদহজমের সমস্যা কম হয় ।
ঠান্ডা এবং জ্বর – ঠান্ডা ও জ্বরের মত সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে কালোজিরা ব্যবহার করা যেতে পারে । বহুদিন আগে থেকেই, সর্দি-কাশির ঘরোয়া প্রতিকার হিসাবে কালোজিরা ব্যবহৃত হয়ে আসছে ( তথ্যসূত্র ) । সেই সাথে কালোজিরা জ্বর কমাতেও কার্যকরী ভুমিকা পালন করে ( তথ্যসূত্র ) । কালোজিরা ঠাণ্ডা ও জ্বর কমাতে সাহায্য করে এটা প্রমানিত, কিন্তু এতে উপস্থিত কোন গুণের কারণে এমনটি ঘটে, তা এখনও সঠিকভাবে জানা সম্ভব হয়নি ।
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে – নিয়মিত কালোজিরা সেবনে, আমাদের রক্ত চলাচলের গতি ত্বরান্বিত হয় । সেই সাথে এটি কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমায় এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে । এর ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটা কমে যায় ।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে – কালোজিরা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে খুব ভাল কাজ করে । NCBI-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, কালোজিরাতে ইমিউনোমোডুলেটরি এবং থেরাপিউটিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে । এই বৈশিষ্ট্যগুলি অ্যালার্জিজনিত বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করতে সক্ষম, যেমন অ্যালার্জিক রাইনাইটিস, হাঁপানি, এটোপিক একজিমা ইত্যাদি । সেইসাথে এগুলো আমাদের ইমিউনিটি সিস্টেম শক্তিশালী করতে অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে কাজ করে ।
ডায়াবেটিসে উপকারী – কালোজিরাতে, পটাশিয়াম এবং গ্লাইসেমিক ইনডেক্স থাকে, যা ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে । যার কারণে কালোজিরা, ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় খুব কার্যকর ভুমিকা পালন করে ।প্রতিদিনের খাবারে কালো জিরা ব্যবহার করলে রক্তে সুগারের মাত্রা কমে, যার ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে ।
ওজন কমানোর জন্য – আপনি যদি স্থূলতা এবং অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি নিয়ে চিন্তায় থাকেন, তাহলে কালোজিরা আপনার উপকারে আসতে পারে । এ বিষয়ে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, কালোজিরার স্থূলতা বিরোধী গুণ রয়েছে, যা ওজন কমাতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে । সেই সাথে, বডি মাস ইনডেক্স এবং কোমরের আকার কিছুটা হলেও হ্রাস পায় । তাই আপনি যদি ওজন কমাতে চান, তাহলে প্রতিদিনের ডায়েটে কালোজিরা অন্তর্ভুক্ত করুন ( তথ্যসূত্র ) ।
পেটে ব্যথা কমায় – পাকস্থলী ও অন্ত্র সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যায় কালোজিরা অত্যন্ত উপকারী ভুমিকা পালন করে । NCBI ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, কালোজিরা পেট ফাঁপা এবং বমি বমি ভাব কমাতে সাহায্য করে ( তথ্যসূত্র )। এছাড়াও, কালোজিরাতে অ্যানালজেসিক প্রভাব রয়েছে, যা ব্যথা কমাতে সাহায্য করে । এই কারণে কালোজিরা পেটের ব্যথা কমাতে কার্যকর বলে মনে করা হয় ( তথ্যসূত্র ) ।
মহিলাদের জন্য দরকারী – কালোজিরা, মেয়েদের মাসিক নিয়মিত এবং স্বাভাবিক করতে সহায়তা করে । অ্যান্টিবায়োটিক বৈশিস্ট্য থাকায় কালোজিরা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণেও কার্যকর ভুমিকা পালন করে । এটি প্রসব-পরবর্তী ইনফেকশন থেকেও মহিলাদের রক্ষা করতে সহায়ক ভুমিকা পালন করে । কালোজিরাতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন রয়েছে, যার কারণে এটি স্তন্যদানকারী মহিলাদের দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সহায়ক ।
ক্যান্সার – ক্যান্সারের মতো মারণ রোগ থেকে সবাই মুক্তি পেতে বা দূরে থাকতে চায় । এমন পরিস্থিতিতে কালোজিরা, ক্যান্সারের সমস্যা থেকে দূরে রাখতে সহায়ক ভুমিকা পালন করতে পারে । এই বিষয়ে NCBI দ্বারা পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, কালোজিরার মধ্যে ক্যান্সার প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সক্ষম । কালোজিরা মুখের ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার, লিউকেমিয়া এবং ব্রেন টিউমারের মতো রোগ প্রতিরোধ করতে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে । তবে মনে রাখবেন যে, কালোজিরা ক্যান্সারের নিরাময় নয়, তাই সমস্যায় একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা গ্রহন করা উচিত ।
মাথাব্যথা – মাথা ব্যথার সমস্যা হলে কালোজিরার পানি পান করতে পারেন । কালোজিরা বহু বছর ধরে মাথাব্যথার ঘরোয়া প্রতিকার হিসবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে । মূলত কালোজিরাতে ব্যথানাশক অর্থাৎ ব্যথা কমানোর প্রভাব রয়েছে, যা মাথাব্যথা কমাতে সাহায্য করে ।
ত্বকের জন্য – ত্বক সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে কালোজিরা খুব কার্যকরী । NCBI ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কালোজিরাতে অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল ও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য থাকার পাশাপাশি, এতে ক্ষত নিরাময় এবং ত্বকের পিগমেন্টেশন হ্রাস করার মত ক্ষমতা রয়েছে । তাই কালোজিরা ব্রণ, ক্ষত, সোরিয়াসিস, পোড়া, প্রদাহ এবং পিগমেন্টেশনের মত সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে সক্ষম ( তথ্যসূত্র )। এছাড়াও একজিমা এবং ত্বক সংক্রান্ত অন্যান্য সমস্যায় কালোজিরার পেস্ট ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায় ।
চুল জন্য – চুলের ক্ষেত্রেও কালোজিরার উপকারিতা দেখা যায় । এই বিষয়ে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, চুলে কালোজিরার তেল লাগালে চুলের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়, গঠন উন্নত হয় এবং চুলের গোড়া শক্ত হয় ( তথ্যসূত্র )। এমন পরিস্থিতিতে যারা চুলের সমস্যায় ভুগছেন, তারা কালজিরার তেল ব্যবহার করতে পারেন ।
কালোজিরার আরও কিছু গুনাগুন নিচে দেওয়া হল –
- কালোজিরা দুশ্চিন্তা এবং মানসিক চাপ কমায়
- কালোজিরা ক্ষুধা বৃদ্ধি করে
- এটি কৃমি ধ্বংস করে
- কালোজিরা জরায়ুর প্রদাহ দূর করে
- প্রসবের পর কালোজিরা খেতে জরায়ু সংকুচিত হয়
- কালোজিরা পাইলসের ক্ষেত্রে উপকারী
- কালোজিরা মুখের দুর্গন্ধ দূর করে
আর্টিকেলের এই অংশে আমরা কালোজিরাতে উপস্থিত বিভিন্ন পুষ্টিকর উপাদান সম্পর্কে বলব ।
কালোজিরার পুষ্টি উপাদান
নিচের টেবিলে কালোজিরার পুষ্টি উপাদানের একটি চার্ট দেওয়া হল –
পুষ্টি উপাদান | প্রতি ১০০ গ্রামে |
---|---|
শক্তি | ৪০০ কিলোক্যালরি |
প্রোটিন | ১৬.৬৭ গ্রাম |
মোট লিপিড (চর্বি) | ৩৩.৩৩ গ্রাম |
কার্বোহাইড্রেট | ৫০ গ্রাম |
আয়রন | ১২ মিলিগ্রাম |
কালোজিরার ব্যবহার – কালোজিরা কীভাবে ব্যবহার করবেন
বছরের পর বছর ধরে কালোজিরা বিভিন্ন ভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে । নিচে কালোজিরা কীভাবে ব্যবহার করবেন সে সম্পর্কে তথ্য দেওয়া হল –
- সবজি রান্না করার সময় কালোজিরা বা এর গুঁড়া দিতে পারেন ।
- কালোজিরা স্ন্যাকস বা কুকি তৈরিতেও ব্যবহার করা যেতে পারে ।
- রুটি এবং নান তৈরি করার সময় কালোজিরা যোগ করতে পারেন ।
- পোলাও বা বিড়িয়ানি তৈরি করার সময় কালোজিরা ব্যবহার করা যেতে পারে ।
- ডাল রান্না করার সময় কালোজিরা ব্যবহার করা যেতে পারে ।
- আচার তৈরির সময়ও কালোজিরা যোগ করা যেতে পারে ।
- পানিতে কালোজিরা ফুটিয়ে নিয়ে পান করতে পারেন ।
- কালোজিরার বেটে নিয়ে পেস্ট তৈরি করে ত্বকের সমস্যায় আক্রান্ত স্থানে লাগান ।
- চায়ের সাথে কালোজিরা দিয়ে পান করতে পারেন ।
- কালোজিরা তেল মাথায় ব্যবহার করতে পারেন ।
আরও পড়ুনঃ কিভাবে ক্ষুধা বাড়ানো যায় ? ক্ষুধা বাড়ানোর ঘরোয়া উপায়
কালোজিরার অসুবিধা – কালোজিরার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
আর্টিকেলের এই পর্যায়ে আমরা কালোজিরার ক্ষতি বা কালোজিরার অপকারিতা সম্পর্কে তথ্য দেব । যদিও কালোজিরা আমাদের খুব একটা ক্ষতি করে না, কিন্তু বেশি পরিমাণে গ্রহন করলে নিম্নলিখিত কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে ।
- কেউ যদি কালোজিরার তেল অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহন করে, তাহলে তার পেটে ব্যথা হতে পারে ( তথ্যসূত্র )
- গর্ভকালীন সময়ে কালোজিরা ব্যবহার করার আগে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নিন ( তথ্যসূত্র )।
- কালোজিরা, আঘাতের কারণে বের হওয়া রক্ত প্রবাহকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে । মূলত কালোজিরাতে থাইমোকুইনোন নামক এক ধরনের উপাদান থাকে, যা রক্ত জমাট বাঁধার গতি কমিয়ে দেয় । এই কারণে আঘাতের সময় রক্ত জমাট বাধতে দেরী হয় ।
শেষ কথা
আজকের এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনি আপনি নিশ্চই বুঝতে পেরেছেন যে, কালোজিরা আমাদের সার্বিক স্বাস্থ্যের জন্য কতটা উপকারী হতে পারে । তাই প্রতিদিনের খাদ্য তৈরি করার সময় কালোজিরা ব্যবহার করতে পারেন । তবে অতিরিক্ত পরিমাণে কালোজিরা খাওয়া থেকে বিরত থাকুন । স্বাদ ও ঔষধি গুণে ভরপুর কালোজিরার উপকারিতা পেতে প্রতিদিন কালোজিরা পানি পান করুন । আর্টিকেলটি নিয়ে যে কোন ধরনের প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে কমেন্ট সেকশনে জানান ।