ক্ষুধা না লাগা বা খেতে ইচ্ছা না করা একটি গুরুতর সমস্যা, যা পরবর্তীতে মারাত্মক আকার ধারন করতে পারে । ক্ষুধা না থাকার কারণে একজন মানুষ কম পরিমাণে খাবার গ্রহন করে, যার কারণে শরীর সম্পূর্ণ রূপে পুষ্টি পায় না । বিশেষ করে কর্মজীবী মানুষের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা যায় । ক্ষুধা হ্রাসের পিছনে মানসিক এবং শারীরিক দুই ধরনের কারণই থাকতে পারে । ক্ষুধার অভাব শরীরকে অনেক রোগের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে, তাই এই সমস্যাটিকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয় । আজকের আর্টিকেলে আমরা আপনাদের সাথে, ক্ষুধা হ্রাসের কারণগুলির পাশাপাশি কীভাবে ক্ষুধা বাড়ানো যায় সে সম্পর্কে আলোচনা করব । এগুলো আপনার ক্ষুধা বাড়াতে সাহায্য করবে ।
Table of Contents
ক্ষুধা না লাগার কারণ – ক্ষুধা হ্রাসের কারণ
ক্ষুধা কমে যাওয়ার সমস্যা কয়েক দিন বা তার বেশি সময় ধরে স্থায়ী হতে পারে । ক্ষুধা না লাগার কারণে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে –
- বিষণ্ণতা
- মানসিক চাপ
- হরমোনের ভারসাম্যহীনতা
- কোনো গুরুতর অসুস্থতা
- ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে
আরও পড়ুনঃ কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণ, লক্ষণ এবং ঘরোয়া প্রতিকার
ক্ষুধা বাড়ানোর ঘরোয়া উপায় – কিভাবে ক্ষুধা বাড়ানো যায়
ক্ষুধা না লাগার সমস্যা যে সমাধান করা যাবে না তা কিন্তু নয় । নীচে আমরা কিছু ঘরোয়া প্রতিকার সম্পর্কে বলছি, যার সাহায্যে আপনি ক্ষুধা বৃদ্ধি করে সুস্থ জীবন উপভোগ করতে পারবেন –
আদা – আধা চা চামচ ধনে গুঁড়ো এবং আধা চা চামচ আদা গুঁড়ো ভালোভাবে মিশিয়ে নিন । এবার এই মিশ্রণটি ১ গ্লাস পানিতে দিয়ে সেই পানি ফুটিয়ে অর্ধেক করুন । এবার হালকা ঠান্ডা করে ধীরে ধীরে চায়ের মতো পান করুন । প্রতিদিন ১ বার এই মিশ্রণ পান করুন । আদা অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি, অ্যান্টি-হাইপারটেনসিভ, গ্লুকোজ এবং উদ্দীপক বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ । এটি গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল (গ্যাস্ট্রিক) ট্র্যাক্টে খুব ভাল কাজ করে ( তথ্যসূত্র ) । এভাবেই ক্ষুধা বাড়ানোর উপায় হিসেবে আদা খাওয়া যেতে পারে ।
তেঁতুল – এক গ্লাস পানিতে কিছুটা তেতুল নিয়ে কয়েক ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন । এরপর সেই তেতুল পানির সাথে স্বাদমতো লবণ ও কাঁচা মরিচ মিশিয়ে নিন । এরপর পানি ভালো করে ছেঁকে নিয়ে পান করুন । প্রতিদিন একবার করে এই তেতুল পানির শরবত পান করুন । তেঁতুল একটি জনপ্রিয় রেচক, যা অনেকে রান্নায় ব্যবহার করে । এটি পাচনতন্ত্রের কার্যকারিতা উন্নত করে এবং ক্ষুধা বৃদ্ধি করে । তেঁতুলে, ভিটামিন-বি ১ অর্থাৎ থায়ামিন থাকে, যা ক্ষুধা বাড়াতে সাহায্য করে ।
ধনিয়া – ব্লেন্ডারে ধনেপাতা এবং পানি নিয়ে জুস তৈরি করুন । এরপর ধনেপাতার এই জুস প্রতিদিন সকালে খালি পেটে পান করুন । ক্ষুধা বাড়ানোর ঘরোয়া উপায় হিসেবে ধনে পাতা ব্যবহার করতে পারেন । খাবার বা সালাদে ধনিয়া পাতা বহুদিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে । ধনিয়া পাতার প্রদাহ-বিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং এটি হজমের উন্নতি করে ক্ষুধা বাড়াতে সাহায্য করে ।
ডালিমের রস – জুসারের সাহায্যে ডালিমের রস বের করে তাতে স্বাদ মত মধু যোগ করুন । তারপর সামান্য ঠাণ্ডা করে ডালিমের জুস পান করুন । ক্ষুধা না লাগার সমস্যা থাকাকালীন প্রতিদিন ১ গ্লাস করে পান করুন । ডালিম খুব উপকারী একটি ফল, এতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন রয়েছে । ডালিম হজমের জন্য অত্যন্ত উপকারী । ক্ষুধা বাড়ানোর জন্য আপনি প্রতিদিন ডালিমের রস পান করতে পারেন ।
আমলা – আমলার জুস বাজারে সহজেই কিনতে পাওয়া যায় বা আপনি বাড়িতেও আমলার রস বের করতে পারেন । বাড়িতে আমলার রস বের করার জন্য, প্রথমে ফ্রেশ আমলা বেছে নিন এবং বীজগুলিকে ছাড়িয়ে ছোট ছোট টুকরো করে কেটে ব্লেন্ডারে দিয়ে, কিছুটা পানি মিশিয়ে ব্লেন্ড করুন । এরপর একটি পরিষ্কার সুতির কাপড়ের সাহায্যে জুসটি ছেঁকে নিন । এরপর ২০-৩০ মিলি আমলার রস আধা কাপ পানির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে পান করুন । সমস্যার দিন গুলোতে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এই মিশ্রণ পান করুন । ক্ষুধা বাড়াতে আমলার রস খাওয়া যেতে পারে । প্রকৃতপক্ষে, আমলাতে ভিটামিন-সি এবং গ্যাস্ট্রোপ্রোটেকটিভ বৈশিষ্ট্য রয়েছে । এটি হজম শক্তি বৃদ্ধি করে এবং ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে । তাই ক্ষুধা বাড়ানোর ওষুধ হিসেবে আমলার জুস পান করা যেতে পারে ।
লেবু – ১ গ্লাস হালকা গরম পানির সাথে অর্ধেক লেবুর রস মিশিয়ে ছেঁকে নিন । এরপর প্রতিদিন খালি পেটে এই লেবুর রস পান করুন । ক্ষুধা বাড়ানোর ওষুধ হিসেবে লেবুর রস খুব ভাল কাজ করে । লেবুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি রয়েছে, যা পেট পরিষ্কার করে পরিপাকতন্ত্রের কাজ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে । এছাড়াও লেবুতে প্রচুর পরিমাণে ডায়েটারি ফাইবার রয়েছে, যা অন্ত্রকে সুস্থ রাখে । তাই ক্ষুধা বাড়ানোর ঘরোয়া প্রতিকার হিসেবে লেবু ব্যবহার করা যেতে পারে ।
এলাচ – দুই থেকে তিনটি সাদা এলাচ, এক টুকরো আদা, ২ টি লবঙ্গ, এক-চতুর্থাংশ চা চামচ ধনে বীজ এবং এক গ্লাস হালকা গরম পানি ব্লেন্ডারে নিয়ে ভাল করে মিশিয়ে নিন । ক্ষুধা না লাগার সমস্যা থাকাকালীন সময়ে প্রতিদিন এই মিশ্রণটি সকালে খালি পেটে পান করুন । প্রাচিনকাল থেকেই এলাচ বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং ক্ষুধা হ্রাসের মতো সমস্যার জন্য ব্যবহার হয়ে আসছে । ক্ষুধা বাড়ানোর ঘরোয়া উপায় হিসেবে এলাচ খাওয়া যেতে পারে ।
মৌরি চা – ১ চামচ মৌরি এবং মেথি বীজ, এক গ্লাস পানিতে নিয়ে কয়েক মিনিট ফুটিয়ে ছেঁকে নিন । স্বাদের জন্য আপনি এই মিশ্রণের সাথে ১ চা চামচ মধুও যোগ করতে পারেন । এবার মিশ্রণটি ছেঁকে নিয়ে হালকা গরম অবস্থায় ধীরে ধীরে চায়ের মতো পান করুন । প্রতিদিন ১ বার করে এই মৌরি চা পান করুন । মৌরি ক্ষুধা বর্ধক হিসেবে কাজ করে এবং হজমশক্তিও বৃদ্ধি করে । ক্ষুধা বাড়ানোর ঘরোয়া প্রতিকার হিসেবে মৌরি ব্যবহার করা যেতে পারে ।
গোলমরিচ – ক্ষুধা না লাগার সমস্যা থাকা অবস্থায় আপনি প্রতিদিন দুই থেকে তিনটি গোল মরিচ খেতে পারেন অথবা গোল মরিচের চা তৈরি করে পান করতে পারেন । গোল মরিচের চা তৈরি করতে, প্রথমে একটি প্যানে দেড় কাপ পানি গরম করতে দিন ।
এরপর এতে এতে সামান্য আদা কুচি, চা পাতা ও গোল মরিচ দিয়ে ভালো করে ৪ থেকে ৫ মিনিট ফুটিয়ে নিন । এরপর চা ছেঁকে নিন এবং এতে স্বাদ অনুযায়ী চিনি বা মধু মিশিয়ে ধীরে ধীরে পান করুন । ক্ষুধামন্দার সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে গোল মরিচ ব্যবহার করা যেতে পারে । গোল মরিচ হজম শক্তিকে শক্তিশালী করে এবং ক্ষুধা বাড়ায় ।
ভিটামিন – ভিটামিন-বি সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক এবং শিশুদের ক্ষুধা বাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয় । ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স গ্রুপের, যেকোনো ভিটামিনের ঘাটতি হজমের সমস্যা এবং ক্ষুধা না লাগার সমস্যা তৈরি করতে পারে ( তথ্যসূত্র ) । ক্ষুধা বাড়ানোর জন্য ভিটামিন-বি সমৃদ্ধ খাবারও খাওয়া যেতে পারে । যেমন- মাছ, মাংস, ডিম, মুরগি, দুগ্ধজাত দ্রব্য, সবুজ শাকসবজি এবং মটরশুটি বি ভিটামিনের খুব ভালো উৎস ( তথ্যসুত্র )। এছাড়াও ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন ওষুধও খেতে পারেন ।
আরও পড়ুনঃ অ্যাসিডিটির কারণ, লক্ষণ এবং ঘরোয়া প্রতিকার
ক্ষুধা বাড়ানোর জন্য কিছু টিপস – ক্ষুধা বাড়ানোর টিপস
উপরে উল্লিখিত ঘরোয়া প্রতিকারগুলো ছাড়াও, নীচে উল্লিখিত টিপসগুলো ক্ষুধা বাড়াতে ব্যবহার করা যেতে পারে –
- হজম শক্তি বাড়াতে এবং ক্ষুধা বাড়াতে নিয়মিত ব্যায়াম করুন ।
- খাওয়ার সময়, খাবারের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত । বিশেষ করে, শিশুরা খাওয়ার সময় টিভি বা মোবাইলের দিকে মনোযোগ দিতে শুরু করে, যার কারণে তারা ঠিকমতো খাবার খেতে পারে না ।
- প্রতিদিন সময়মতো খাবার খান । সময়মতো খাবার না খেলে ক্ষুধা কমে যেতে পারে । সকালের নাস্তায় একটু ভারী খাবার খান, দুপুরের খাবার সকালের নাস্তার থেকে কম খান এবং রাতের খাবার একদম হালকা হওয়া উচিত ।
- জাঙ্ক ফুড খাওয়া থেকে দূরে থাকুন এবং আপনার প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় সবুজ শাকসবজি এবং তাজা ফল অন্তর্ভুক্ত করুন । প্রতিদিন সকালের নাস্তার সময় ফলের রস খেতে পারেন । প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার অন্তর্ভুক্ত করুন ।
- প্রত্যেক সময় খাওয়ার আগে সামান্য হাঁটাহাঁটি করুন, এতে খাওয়ার রুচি বাড়বে ।
- খাওয়া শুরু করার আগে বা খাওয়ার মাঝখানে পানি পান করবেন না । এতে আপনার ক্ষুধা নষ্ট হয়ে যেতে পারে ।
- উদ্বেগ এবং মানসিক চাপ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন ।
- খাবার খাওয়ার সময় বড় প্লেট ইউজ করুন । বড় প্লেটে স্বাভাবিক পরিমাণ খাবার খেলেও আপনার মনে হবে যে আপনি কম খেয়েছেন । স্বাভাবিকভাবেই তখন আরেকটু বেশি খাওয়ার ইচ্ছা জাগবে । গবেষণায় দেখা গেছে যে, ছোট প্লেটের তুলনায় বড় প্লেট, বেশি পরিমাণ খাবার খেতে মানুষকে উৎসাহিত করে ।
শেষ কথা
ব্যস্ত জীবনযাত্রায় ক্ষুধা কমে যাওয়ার সমস্যা যে কারোরই হতে পারে । তবে এই সমস্যা উপেক্ষা করা উচিত নয় । আর্টিকেলে উল্লিখিত ঘরোয়া উপায়গুলো ক্ষুধা বাড়াতে ব্যবহার করতে পারেন । এই সমস্ত প্রতিকার সম্পূর্ণরূপে প্রাকৃতিক এবং কার্যকর ।এছাড়াও, যদি এই প্রতিকারগুলি ব্যবহার করার সময় বমি বমি ভাব, অ্যালার্জি বা বমির মতো কোন উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে সেগুলি ব্যবহার করা বন্ধ করুন । একই সাথে, ঘরোয়া প্রতিকার অবলম্বন করার পরেও যদি কোনো ইতিবাচক প্রভাব না দেখা যায়, তাহলে দ্রুত একজন চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন । আর্টিকেলটি নিয়ে যে কোন ধরনের প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে কমেন্ট সেকশনে জানান ।