আমরা জানি যে, প্রাচীন যুদ্ধে যোদ্ধারা ঢাল তরোয়াল ছাড়াও তীর-ধনুক ব্যবহার করত। এই তীর হল এমন এক অস্ত্র, যা একজন যোদ্ধা তার ধনুকের মাধ্যমে শত্রু যোদ্ধাকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করত। আক্ষরিক অর্থে এই ধরনের অস্ত্রকেই বর্তমানে ক্ষেপণাস্ত্র বলা হয়। এই ক্ষেপনাস্ত্রগুলোকে ইংরেজিতে মিসাইল বলে। একইভাবে, আজকের মিসাইল হল সেই অস্ত্র যা যুদ্ধ করতে গিয়ে শত্রু সৈন্যদের দিকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করা হয়। সময়ের সাথে সাথে যুদ্ধ প্রযুক্তির উন্নতি হচ্ছে এবং ক্ষেপণাস্ত্রের ধরনও উন্নত হচ্ছে। তবে যদি সাধারণ ভাবে শ্রেণীবিভাগ করা হয়, তাহলে মিসাইল বা ক্ষেপণাস্ত্র দুই ধরনের – ক্রুজ মিসাইল এবং ব্যালিস্টিক মিসাইল।
Table of Contents
ব্যালিস্টিক মিসাইল – Ballistic missile কি
ব্যালিস্টিক মিসাইল বা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হল এমন এক ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র যা একটি সাব-অরবিটাল ব্যালিস্টিক পথ দিয়ে তার লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করে। এই ধরনের মিসাইল পারমাণবিক বোমা বহন করতে ব্যবহার করা যেতে পারে । এই ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রথমে তার অবস্থান থেকে 45 ডিগ্রি কোণে উপরে উঠে যায়, তারপর এটি মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে নিচে নেমে আসে। বেশি উচ্চতা থেকে লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছানোর কারণে এটি খুব সহজেই রাডারে ধরা পড়ে।
আরও সহজ কথায় বলতে গেলে, যখন কোন মিসাইলের সাথে গাইডেন্স ডিভাইস লাগানো হয়, তখন সেই মিসাইলটি ব্যালিস্টিক মিসাইলে পরিণত হয়। যখন এই ধরনের মিসাইলকে তার স্থান থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় বা নিক্ষেপ করা হয়, তখন এটি পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষনের নিয়ম অনুসারে তার পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুর উপরে আঘাত করে। এই ধরনের মিসাইল নিক্ষেপ করার পর, এটি প্রথমে খুব দ্রুত উপরের দিকে উঠে যায় এবং তারপর অভিকর্ষ বলের প্রভাবে খুব দ্রুত নিচে এসে সেটির লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে। মূলত, এই ক্ষেপণাস্ত্রটি যখন নিক্ষেপ করা হয়, তখন উপরে যাওয়ার সময় এটি পৃথিবীর উপরের বায়ুমণ্ডলে চলে যায় এবং তারপরে নিচের দিকে নেমে আসে। এইভাবে যাওয়া এবং আসার কারণে এই মিসাইলকে ব্যালিস্টিক মিসাইল বলা হয় । এই ধরনের মিসাইলের রেঞ্জ 5000 কিমি থেকে শুরু করে 10000 কিমি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই মিসাইলে যে গাইডেন্স যন্ত্র ইনস্টল করা হয়েছে, তার কারণে এটি উৎক্ষেপণের একেবারে শুরুতেই লক্ষ্যবস্তুর দিকে নির্দেশ করা হয়। এরপরে, এই মিসাইল উপরে যাওয়ার সাথে সাথে অরবিটাল মেকানিক্সের নীতি এবং ব্যালিস্টিক নীতিগুলির মাধ্যমে এর দিকনির্দেশ করা হয়। বর্তমানে, ব্যালিস্টিক মিসাইলগুলো রাসায়নিক রকেট ইঞ্জিন দ্বারা চালিত হয়। এই মিসাইল গুলির প্রচুর পরিমাণে বিস্ফোরক বহন করার ক্ষমতা রয়েছে ।
প্রথম ব্যালিস্টিক মিসাইল
বিশ্বের মিসাইলের ইতিহাসে প্রথম ব্যালিস্টিক মিসাইলটি 1930 থেকে 1940 সালের মধ্যে নাৎসি জার্মানি দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল । এই মিসাইল তৈরির কাজটি রকেট বিজ্ঞানী ওয়েইনহার ভন ব্রাউনের পৃষ্ঠপোষকতা এবং তত্ত্বাবধানে করা হয়েছিল। তার তৈরি করা প্রথম ব্যালিস্টিক মিসাইলের নাম ছিল A4 । যা অন্য কথায় V-2 রকেট নামেও অনেকের কাছে পরিচিত। 1942 সালের 3 অক্টোবর প্রথম এই মিসাইল পরীক্ষা করা হয়েছিল।
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার
এই মিসাইলটি সর্বপ্রথম 6 সেপ্টেম্বর 1944 সালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল এবং এর ঠিক দুই দিন পরে এটি লন্ডনে ব্যবহার করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে, অর্থাৎ 1945 সালের মে মাসে, এই ব্যালিস্টিক মিসাইল বহুবার ব্যবহার করা হয়েছিল।
ব্যালিস্টিক মিসাইল ক্লাস এবং রেঞ্জ
ব্যালিস্টিক মিসাইলগুলিকে সাধারণত নিম্নলিখিত শ্রেণীতে ভাগ করা হয়:
শ্রেণীবিভাগ | সংক্ষেপে | রেঞ্জ |
---|---|---|
ক্লোজ রেঞ্জ ব্যালিস্টিক মিসাইল | সিআরবিএম | 50-300 কিমি |
স্বল্প পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল | এসআরবিএম | 300-1000 কিমি |
মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল | এমআরবিএম | 1000-3000 কিমি |
ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ ব্যালিস্টিক মিসাইল | আইআরবিএম | 3000-5500 কিমি |
ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল | আইসিবিএম | > 5500 কিমি |
সাবমেরিন থেকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ | এসএলবিএম | পরিবর্তিত হয় |
এয়ার লঞ্চড ব্যালিস্টিক মিসাইল | ALBM | পরিবর্তিত হয় |
ব্যালিস্টিক মিসাইলের উপাদান
সব ধরনের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ৩ টি অপরিহার্য উপাদান নিয়ে গঠিত । একটি হল প্রপালশন সিস্টেম, যা মিসাইলকে তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে । ২য় টি হল গাইডেন্স সিস্টেম, যা চালিত ফ্লাইটের সময় ক্ষেপণাস্ত্রের স্টিয়ারিং ধারণ করে এবং ব্যালিস্টিক ট্র্যাজেক্টোরির জন্য সঠিক অবস্থা নিশ্চিত করে । এবং ৩য় টি হল পেফলোড, যা লক্ষ্যকে ধ্বংস করে।
প্রপালশন
রকেট প্রপালশন একটি জ্বলন চেম্বারে জ্বালানী এবং একটি অক্সিডাইজারকে একত্রিত করে, যেখানে রাসায়নিক বিক্রিয়া উচ্চ-চাপ এবং উচ্চ তাপমাত্রার গ্যাস তৈরি করে। এই গ্যাস নিঃশেষ করার ফলে থ্রাস্ট তৈরি হয় যা ক্ষেপণাস্ত্রকে সামনের দিকে চালিত করে।
ব্যালিস্টিক মিসাইল, কঠিন বা তরল প্রোপেলান্ট রকেট প্রপালশন সিস্টেম ব্যবহার করতে পারে । সাধারণভাবে, তরল সিস্টেম কঠিন সিস্টেমের তুলনায় কিছুটা বেশি শক্তিশালী হয় । সলিড প্রোপেল্যান্ট সিস্টেমের সুবিধা হল এগুলি রুক্ষ, সহজে স্টোর করে রাখা যায় এবং সহজে পরিবহনযোগ্য । আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায় সলিড প্রোপেল্যান্ট সিস্টেম বেশী ব্যবহার করা হচ্ছে । তবে কিছু কিছু দেশ এখনও তরল প্রোপেলান্ট প্রযুক্তি বেশী ব্যবহার করছে এবং সেই কারণে নতুন তরল প্রোপেলান্ট সিস্টেম সহ মিসাইল তৈরি করা অব্যাহত রয়েছে।
গাইডেন্স সিস্টেম
একটি ব্যালিস্টিক মিসাইলের নির্ভুলতা নির্ভর করে তার ফ্লাইটের সঠিক বেগ এবং মহাকাশে অবস্থান অর্জন করার ক্ষমতার উপর। এই বেগ এবং অবস্থান সঠিক করা হল গাইডেন্স এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কাজ । মিসাইল উৎক্ষেপণের পর থেকে , inertial navigation system (INS) যন্ত্রগুলিকে অবশ্যই ক্ষেপণাস্ত্রের ত্বরণের সমস্ত উপাদানগুলিকে ক্রমাগতভাবে ফলো করতে হবে৷ গাইডেন্স কম্পিউটার ক্ষেপণাস্ত্রের “স্থিতি” (অর্থাৎ বেগ, অবস্থান এবং অভিযোজন) নির্ধারণ করতে এই ত্বরণ ব্যবহার করে এবং ফ্লাইট প্রোফাইল থেকে বিচ্যুতি দূর করতে মিসাইলের স্টিয়ারিং সিস্টেমে সংশোধনমূলক বার্তা পাঠায়।
পেলোড
ব্যালিস্টিক মিসাইল পেলোড সাবসিস্টেমের কাজ হল, অস্ত্রটি লক্ষ্যে পৌঁছানো এবং সঠিক সময়ে ও সঠিক স্থানে বিস্ফোরণ ঘটানো । ব্যালিস্টিক মিসাইল পেলোড হতে পারে পারমাণবিক অথবা রাসায়নিক/জৈবিক । রাসায়নিক এবং জৈবিক অস্ত্রগুলিকে স্বল্প-পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইলের জন্য পেলোড সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।