আমাদের হৃদপিন্ড একটি পেশীবহুল অঙ্গ, যা প্রতিদিন প্রায় 1 লক্ষ বার স্পন্দিত হয়। সাধারণত হৃৎপিণ্ড আমাদের বুকের বাম পাশে অবস্থিত, যা 24 ঘন্টায় আমাদের পুরো শরীরে প্রায় 5000 গ্যালন রক্ত পাম্প করে। এই হৃৎপিণ্ডের প্রধান কাজ হল আমাদের টিস্যুতে অক্সিজেন এবং বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি সরবরাহ করা। যদি এই অঙ্গটি কোন কারণে তার কার্য সম্পাদন করতে ব্যর্থ হয়, তবে এর ফলাফল প্রাণঘাতী পর্যন্ত হতে পারে। তাহলে চলুন আজকের আর্টিকেলে হার্ট অ্যাটাক কি এবং হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক ।
Table of Contents
হার্ট অ্যাটাক কি – Heart Attack কি
ডাক্তারি পরিভাষায় হার্ট অ্যাটাককে বলা হয় মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন ( myocardial infarction or MI )। ‘মায়ো’ শব্দের অর্থ হল পেশী এবং ‘কার্ডিয়াল’ শব্দের অর্থ হল হৃদয় । অন্যদিকে, ‘ইনফার্কশন’ বলতে অপর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহের কারণে টিস্যু ধ্বংস হওয়াকে বোঝানো হয় । এই হার্ট এট্যাকের কারণে, আমাদের হৃৎপিণ্ডের পেশীর দীর্ঘমেয়াদী বা স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। হার্ট অ্যাটাক হল এমন এক অবস্থা যেখানে একটি ধমনী, যা সাধারণত হৃৎপিণ্ডের পেশীতে রক্ত সাপ্লাই বা সরবরাহ করে তা হঠাৎ করে সম্পূর্ণ ব্লকেজের কারণে বন্ধ হয়ে যায় । এর কারনে হৃদপিন্ডের পেশী কোষগুলো মারা যায়। যে কোন ধমনীতে ব্লকেজ, সাধারণত প্লেক জমার কারণে হয় । যদি এই অবস্থায় সঠিকভাবে চিকিৎসা না করানো হয়, তবে পরবর্তীতে এটি যে কোনও ব্যক্তির জন্য মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন বা হার্ট অ্যাটাকের কারণে হার্টের টিস্যু কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হবে তা নির্ভর করে আক্রমণের সময়কালের উপর । আপনি যদি আগে থেকেই রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা গ্রহন করেন, তাহলে আপনার হার্টের ক্ষতি অনেক কম হবে ।
হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ
মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন বা হার্ট অ্যাটাকের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণটি হল বুকে ব্যথা বা বুকে অস্বস্তি হওয়া । কিন্তু হার্ট অ্যাটাকের আরও কিছু লক্ষণ রয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি নিচে দেওয়া হল –
শরীরের উপরের অংশে ব্যথা – যদি আপনার বুকে ব্যথা, অস্বস্তি বা আপনার বাহুতে (বিশেষ করে আপনার বাম হাত), ঘাড়, চোয়াল এবং কাঁধে চাপ অনুভব করেন, তাহলে আপনার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ।
অত্যধিক ঘাম – আপনার যদি হঠাৎ প্রচণ্ড ঘাম হয় তাহলে এটিকে কখনোই উপেক্ষা করবেন না । বিশেষ করে যদি হার্ট অ্যাটাকের অন্যান্য লক্ষণগুলি আপনার মধ্যে থাকে ।
হঠাৎ মাথা ঘোরা – খালি পেট থেকে আরম্ভ করে ডিহাইড্রেশন পর্যন্ত অনেক কিছুই আছে যেগুলোর কারণে আপনি মাথা ঘোরা অনুভব করতে পারেন । কিন্তু আপনি যদি এই মাথা ঘোরার পাশাপাশি বুকে কোনো ধরনের অস্বস্তি বা ব্যাথা অনুভব করেন, তাহলে তা হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ হতে পারে । গবেষণায় দেখা গেছে যে হার্ট অ্যাটাকের এই লক্ষণ টি মহিলাদের মধ্যে বেশী দেখা যায় ।
হঠাৎ হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া – হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি বা হ্রাস অনেক কারণেই হতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে অত্যধিক ক্যাফিন সেবন এবং ঠিকমত ঘুম না হওয়া । কিন্তু আপনি যদি অনুভব করেন যে আপনার হৃদপিণ্ড কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে অত্যধিক দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে, তাহলে যত দ্রুত সম্ভব একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে চিকিৎসা নেওয়া উচিত ।
সর্দি কাশি – সাধারণত, সর্দি এবং ফ্লুর লক্ষণগুলি হার্ট অ্যাটাকের লক্ষন হিসাবে বিবেচিত হয় না । কিন্তু আপনি যদি, স্থূলকায় এবং ডায়াবেটিসে ভুগে থাকেন, এবং যদি ফ্লু-এর মতো উপসর্গগুলি অনুভব করেন যা অনেকদিন ধরে ঠিক হচ্ছে না । তবে আপনার কফ পরীক্ষা করুন । আপনার কফের গোলাপী রঙ নির্দেশ করে যে আপনার হৃদপিন্ড তার ক্ষমতা অনুযায়ী সঠিকভাবে কাজ করছে না । এমন পরিস্থিতিতে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহন করুন ।
শ্বাস নিতে সমস্যা – বুকে ব্যাথা বা অস্বস্তির পাশাপাশি আপনি যদি শ্বাস নিতে সমস্যা অনুভব করেন তাহলেও আপনার হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি রয়েছে ।
ক্লান্ত অনুভব করা – বুকে ব্যাথা বা অস্বস্তির পাশাপাশি যদি আপনি অল্প পরিশ্রম করেই ক্লান্ত অনুভব করেন তাহলে আপনার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে । এই সব পরিস্থিতিতে দেরী না করে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত ।
বমি বমি ভাব – উপরের লক্ষনগুলোর পাশাপাশি যদি আপনি বমি বমি ভাব অনুভব করেন তাহলে আপনার হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা অনেক বেশী রয়েছে ।
হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হলে কী করবেন
হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হলে ভয় না পেয়ে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করুন । দ্রুত জোড়ে জোড়ে এবং ঘন ঘন কাশি দিতে থাকুন, যেন কাশির সাথে কফ বের হয়ে আসে । প্রত্যেকবার কাশি দেওয়ার পূর্বে দীর্ঘশ্বাস নিন । ২ মিনিট পর পর এভাবে ঘন ঘন কাশি ও দীর্ঘশ্বাস নিতে থাকুন । এতে করে আপনার হার্টে কিছুটা হলেও রক্ত সঞ্চালন শুরু হবে । হাসপাতালে নেওয়ার মাঝখানে এটি রোগীকে অনেকটা সাপোর্ট দেবে । কারণ, দীর্ঘশ্বাস নেওয়ার কারণে আমাদের শরীরে অক্সিজেন পরিবহন বেশি হয় এবং ঘন ঘন কাশি দেওয়ার কারণে আমাদের বুকে যে চাপের সৃষ্টি হয়, তাতে হার্ট পর্যাপ্ত ও নিয়মিতভাবে রক্ত সঞ্চালন করার জন্য প্রস্তুত হয়।
হার্ট অ্যাটাকের কারণ কী?
আমাদের হৃৎপিণ্ডের পেশীতে ক্রমাগত অক্সিজেন সহ রক্তের প্রয়োজন হয়, যা করোনারি ধমনী বহন করে। আপনার ধমনীতে যখন প্লাক তৈরী হয় তখন এই রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় । যার ফলে শিরাগুলি সংকুচিত হয়ে যায় । এটি Fat, ক্যালসিয়াম, প্রোটিন এবং Inflammatory cells দ্বারা তৈরি হয় । ব্লেড জমে যাওয়ার কারণে বাইরের স্তর শক্ত এবং ভেতরের স্তর নরম হয় । প্লেক যখন শক্ত হয়ে যায়, তখন বাইরের খোসা ভেঙ্গে যায় । এটি ফেটে যাওয়ার কারণে শিরার চারপাশে রক্ত জমাট বেঁধে যায় । যদি আপনার ধমনীতে রক্ত জমাট বাঁধে, তবে এটি রক্ত সরবরাহ করতে বাধা দেয়, যার কারণে আপনার হৃদপিণ্ডের পেশীতে অক্সিজেন পৌঁছায় না এবং অবস্থা আরও বেশী খারাপ হয়। যখন এটি ঘটে, তখন পেশীগুলো মারা যায়, যার ফলস্বরূপ হার্টের ক্ষতি হয় । এই ক্ষতির তীব্রতা নির্ভর করে, চিকিৎসা এবং আক্রমণের মধ্যকার সময়ের ব্যবধানের উপর । হার্ট অ্যাটাকের পরে, হার্টের পেশীগুলো নিজেকে মেরামত করতে শুরু করে । এগুলো পুনরুদ্ধার করতে গড়ে প্রায় 2 মাস সময় লাগে।
হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকির কারণ
হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকির পিছনে অনেক ধরনের কারণ থাকতে পারে। এখানে, আমরা আপনাকে সবচেয়ে কমন কিছু কারণ সম্পর্কে বলছি –
বয়স: বয়স আপনার হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ । গবেষণায় দেখা গেছে যে, ৪৫ বছরের বেশি বয়সী পুরুষ এবং ৫৫ বছরের বেশি বয়সী মহিলাদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ।
লিঙ্গ: পুরুষদের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা মহিলাদের চেয়ে ২ থেকে ৩ গুণ বেশি । মহিলাদের শরীরের হরমোন, ইস্ট্রোজেন ইত্যাদি, হার্ট অ্যাটাকের বিরুদ্ধে ঢাল হিসাবে কাজ করে ।
জেনেটিক প্রবণতা: আপনার বংশ পরম্পরায় অর্থাৎ আপনার পরিবারে যদি হৃদরোগের (বাবা-মা, ভাই বা বোন) ইতিহাস থাকে, তাহলে সাধারণ মানুষের তুলনায় আপনার হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় দ্বিগুণ ।
উচ্চ রক্তচাপ: দীর্ঘ দিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপের মাত্রার কারনে আপনার হৃদপিণ্ডে রক্ত সরবরাহকারী ধমনী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা আপনার হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে তোলে।
খারাপ কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের উচ্চ মাত্রা: খারাপ কোলেস্টেরল বা এলডিএল, আপনার ধমনীতে খারাপ প্রভাব ফেলে কারণ এর কারণে আপনার শিরা সরু হয়ে যায়। এছাড়াও, ট্রাইগ্লিসারাইড (রক্তের চর্বি) আপনার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা অনেকখানি বাড়িয়ে দিতে পারে । এই ২ টি বিষয় আপনার প্রতিদিনের খাদ্যের সাথে সম্পর্কিত । তাই হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কম রাখতে সাবধানে এবং পরিমাণমত খাওয়া জরুরী ।
স্থূলতা: শরীরের অতিরিক্ত ওজনের কারণে আপনার LDL, ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে, যা আপনার ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। আর এই সমস্ত কিছুই আপনার হার্ট অ্যাটাকের পিছনে সম্ভাব্য ঝুঁকির কারণ। শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকা এবং সীমিত পরিমাণে খাবার গ্রহন করা হল একটি আদর্শ শরীরের ওজন বজায় রাখার মূল ভিত্তি।
ডায়াবেটিস: এই অবস্থাটি আমাদের রক্তে উচ্চ শর্করার মাত্রা দ্বারা চিহ্নিত করা হয় । আর এই ডায়াবেটিস আপনাকে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিতে ফেলতে সক্ষম ।
স্ট্রেস: এটি আপনার শরীরের রক্তচাপের উচ্চ মাত্রা বোঝায় । এই স্ট্রেস, মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন বা হার্ট এট্যাক হওয়ার প্রধান ঝুঁকির কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম।
ধূমপান: এটি আমাদের ধমনীকে শক্ত করে এবং আমাদের শরীরে রক্তচাপের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় । যার ফলে আপনার হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকটা বেড়ে যায় ।
হার্ট অ্যাটাক নির্ণয়
হার্ট অ্যাটাক সাধারণত নির্দিষ্ট ক্লিনিক্যাল পরিক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা যেতে পারে । সাধারণত নিম্নলিখিত পরীক্ষা গুলি চালিয়ে হার্ট এট্যাক নিশ্চিত করা হয়ে থাকে –
ECG: ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম বা ECG হল এমন একটি ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা, যা আমাদের হৃৎপিণ্ডের মধ্য দিয়ে ভ্রমণকারী ইলেক্ট্রিক সিগন্যাল পরিমাপ করে । এই সংকেতগুলি তখনই পরিমাপ করা হয়, যখন হৃৎপিণ্ড তার চেম্বারগুলির মাধ্যমে রক্ত পাম্প করে। এটি বিভিন্ন প্যাটার্নের তরঙ্গ প্রদর্শন করে এবং সেই তরঙ্গগুলোকে একটি গ্রাফে রেকর্ড করা হয় । এই তরঙ্গের প্যাটার্নের উপর ভিত্তি করে, ডাক্তার হার্টের বর্তমান অবস্থা বুঝতে পারেন এবং সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীও ব্যবস্থা গ্রহন করেন ।
রক্ত পরীক্ষা: হার্ট অ্যাটাকের সময় কার্ডিয়াক এনজাইমের উপস্থিতি সনাক্ত করার জন্য রক্তের টেস্ট করা হয় । এই রক্ত পরীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সাহায্যে, আপনার ডাক্তার আক্রমণের আকার এবং এর সময় সনাক্ত করতে সক্ষম হন । কিছু রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্থ হার্ট সেলগুলোর প্রোটিনের মাত্রা পরিমাপ করা হয় ।
ইকোকার্ডিওগ্রাফি: ইকোকার্ডিওগ্রাফি হল হার্ট অ্যাটাকের সময় এবং পরে করা একটি ইমেজিং পরীক্ষা । এটি আপনার চিকিৎসক বুঝতে পারেন যে, আপনার হার্ট সঠিকভাবে পাম্প করছে কিনা । এই পরীক্ষাটির মাধ্যমে এটাও দেখা যায় যে, আক্রমণের সময় আপনার হৃদপিণ্ডের কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কিনা ।
এনজিওগ্রাম: এই ইমেজিং পরীক্ষাটি সাধারণত আমাদের ধমনীতে ব্লকেজ সনাক্ত করার জন্য করা হয় । হার্ট অ্যাটাক নির্ণয় করার জন্য এটি খুব কম সময়ই ব্যবহৃত হয় । এই পরীক্ষায়, একটি তরল রঞ্জক, ক্যাথেটার নামে পরিচিত টিউবের মাধ্যমে আপনার হার্টের ধমনীতে পুশ করা হয় ।
কার্ডিয়াক সিটি বা এমআরআই: এই ইমেজিং পরীক্ষাগুলি আপনার হার্টের পেশীতে কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা নির্ণয় করার জন্য ব্যবহার করা হয় ।
হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা
হার্ট অ্যাটাকের জন্য জরুরী ভিত্তিতে চিকিৎসা করা প্রয়োজন হয় । আপনার হৃৎপিণ্ডের ক্ষতি কমানোর জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসা করানো প্রয়োজন । ওষুধ বা অস্ত্রোপচার কোনটি প্রয়োজন তা চিকিৎসক হার্ট অ্যাটাকের তীব্রতার উপর নির্ভর করে ডিসিশন নেন ।
ওষুধ: চিকিৎসকেরা রক্তের জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করতে, ব্যথা উপশম করতে, হৃদযন্ত্রের ছন্দ নিয়ন্ত্রণ, রক্তনালী প্রসারিত করতে বা রক্তচাপের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ দিয়ে থাকেন । চিকিৎসকেরা অনেক ধরনের ওষুধের পরামর্শ দিতে পারেন, তবে নিচে আমরা সবচেয়ে সাধারণ কিছু ওষুধ সম্পর্কে বলছি ।
নোটঃ ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতিত নিচে উল্লেখিত কোন ওষুধ গ্রহন করবেন না ।
অ্যাসপিরিন: এই ওষুধটি রক্ত জমাট বাঁধা কমাতে সাহায্য করে, যার ফলে সংকীর্ণ ধমনীতেও রক্ত প্রবাহ সচল হয় ।
থ্রম্বোলাইটিক্স: এই ওষুধগুলি হৃৎপিণ্ডে রক্ত সরবরাহকারী ধমনীতে যে জমাট বাঁধে তা অপসারণ করতে কাজ করে । সময়মত থ্রম্বোলাইটিক্স গ্রহণ করলে হার্ট অ্যাটাকের রোগীর বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
অ্যান্টিপ্লেলেটলেট এজেন্ট: এই ওষুধ ধমনীতে নতুন করে কোন কিছু জমাট বাঁধতে দেয় না এবং সেই সাথে বিদ্যমান জমাটগুলিকেও বড় হতে বাধা প্রদান করে ।
ব্যথা উপশমকারী: মরফিন সাধারণত বুকের ব্যথা কমানোর জন্য ডাক্তাররা দিয়ে থাকে ।
বিটা ব্লকার: এগুলি আমাদের হার্টের পেশী শিথিল করে হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক করতে সাহায্য করে । সেইসাথে হৃদপিন্ডের ভাল কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে ব্লাডপ্রেসারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে । বিটা ব্লকার ভবিষ্যতে হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
Ace ইনহিবিটর্স: এই ওষুধগুলি রক্তচাপ কমাতে এজেন্ট হিসাবে কাজ করে । যার ফলে আপনার হার্টের স্ট্রেস লেভেল কমে যায়।
স্ট্যাটিনস: এই ওষুধ আপনার রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে খুব ভাল কাজ করে।
নোটঃ উপরে উল্লেখিত যে কোন ওষুধ গ্রহনের পূর্বে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহন করুন ।
সার্জারি এবং অন্যান্য পদ্ধতি
ড্রাগের পাশাপাশি, হার্ট অ্যাটাকের রোগীর নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলির যে কোনও একটির প্রয়োজন হতে পারে –
অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি: এর মধ্যে রয়েছে করোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করা, অবরুদ্ধ বা সংকুচিত হয়ে যাওয়া ধমনীটি সনাক্ত করা এবং একটি বেলুন দিয়ে ব্লকটিকে ওপেন করা এবং সবশেষে ব্লকের জায়গায় একটি স্টেন্ট স্থাপন করা, যার ফলে ধমনীটি সব সময় ওপেন রাখা যায় এবং রক্ত অবাধে প্রবাহিত হতে পারে ।
বাইপাস সার্জারি: এই পদ্ধতিতে, একজন চিকিৎসক বা সার্জন আপনার হার্টের ব্লক বা সরু ধমনী অপসারণ করে এবং পরবর্তীতে অন্য স্থানে আপনার শিরা বা ধমনী প্রতিস্থাপন করেন। বাইপাস সার্জারি করার পরে রক্ত আবার সঠিকভাবে হার্টে চলাচল করতে পারে ।
হার্ট অ্যাটাকের জন্য খাদ্য
হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসার মেইন ভিত্তি হল, স্ট্রোকের মতো ভবিষ্যতের জটিলতা প্রতিরোধ করা । আপনার খাদ্যাভ্যাস হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে । স্যাচুরেটেড ফ্যাট কম আছে এমন খাবার নিয়মিত গ্রহন করুন। এর কিছু উদাহরণ হল –
- ফলমূল এবং শাকসবজি
- চর্বিহীন মাংস
- মুরগির মাংস (ব্রয়লার মুরগি এড়িয়ে চলুন)
- বাদাম, মটরশুটি এবং লেবু
- মাছ
- গোটা শস্য
- অলিভ অয়েল
- কম চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত পণ্য
প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় স্বাস্থ্যকর খাবার অন্তর্ভুক্ত করা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ । এর পাশাপাশি আপনার ডায়েট থেকে এমন খাবার গুলোকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করুন, যা হার্টের জন্য ক্ষতিকারক । যেমন এর মধ্যে রয়েছে –
- উচ্চ পরিমাণে লবন খাওয়া (বিশেষ করে কাঁচা লবন)
- পরিশোধিত চিনি এবং শর্করা
- প্রক্রিয়াজাত খাবার
- স্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত খাবার
হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধের টিপস
প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় সামান্য কিছু পরিবর্তন এবং কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাস অবলম্বন করলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যাবে । নিচে আমরা কিছু ছোট পদক্ষেপ সম্পর্কে বলব, যেগুলো মেনে চললে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে –
- প্রতিদিন স্বাস্থ্যকর, সুষম খাদ্য গ্রহন করুন (অতিরিক্ত চর্বি/তেল/মাংস এড়িয়ে চলুন; আপনার খাদ্যতালিকায় সবুজ শাকসবজি, ফল, বাদাম, মাছ অন্তর্ভুক্ত করুন) ।
- ধূমপান এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন ।
- আপনার রক্তচাপ, রক্তে শর্করার মাত্রা এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করুন ।
- নিয়মিত অল্প কিছু সময় হলেও ব্যায়াম করুন । স্থূলতা হার্ট অ্যাটাকের পিছনে একটি বড় ঝুঁকির কারণ। তাই শরীরকে যতটা সম্ভব ফিট রাখার চেষ্টা করুন ।
- ধ্যান, শ্বাস-প্রশ্বাসের কৌশল এবং যোগ ব্যায়াম অনুশীলন করে স্ট্রেস কম রাখার চেষ্টা করুন ।
- সম্ভব হলে প্রতি ৬ মাসে একবার আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন ।
হার্ট অ্যাটাক থেকে সেরে উঠতে কত সময় লাগে
হার্ট অ্যাটাক থেকে সুস্থ হয়ে উঠতে কত সময় লাগবে তা নির্ভর করবে আপনার হার্টের পেশী কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তার উপর।হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ২ থেকে ৩ সপ্তাহ পরেই বেশিরভাগ মানুষ সুস্থ হয়ে ওঠেন । আবার অনেকের ক্ষেত্রে সুস্থ হতে কয়েক মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে । আপনি কত দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন তা নির্ভর করে আপনার স্বাস্থ্য, আপনার হার্টের অবস্থা এবং আপনি যে ধরনের কাজ করেন তার উপর।
শেষ কথা
আজকের আর্টিকেলে আমরা আপনাদের সাথে হার্ট অ্যাটাক কি, হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ, হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা, হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধের উপায় ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি । আমরা আশা করছি আজকের আরটিকেলের মাধ্যমে আপনারা হার্ট অ্যাটাকের বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পেড়েছেন ।
আর্টিকেলটি নিয়ে যে কোন ধরনের প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে কমেন্ট সেকশনে জানান ।
ধন্যবাদ