পেঁয়াজ হল যে কোনো খাবারের প্রাণ । যে কোনো খাবার, যেমন- ডাল, সবজি, মাছ, মাংস রান্না করার সময়, তাতে পেঁয়াজ ব্যবহার করলে স্বাদ দ্বিগুণ বেড়ে যায় । এটা হল খাবারের ব্যাপার, তবে আমাদের মধ্যে হয়তো অনেকেই জানেন না যে, এই পেঁয়াজ চুলের জন্য অত্যন্ত উপকারী । পেঁয়াজের রস চুলের জন্য একটি ওষুধের মত কাজ করে । আজকের এই আর্টিকেলে আমরা আপনাদের এই সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করব । চুল ঘন, মজবুত এবং লম্বা করার জন্য পেয়াজ খুব কার্যকরী । আজকের এই আর্টিকেলে, আমরা আপনাদের সাথে, চুলের জন্য পেঁয়াজের রসের উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব এবং সেই সাথে কীভাবে এটি ব্যবহার করবেন সে সম্পর্কেও তথ্য দেয়ার চেষ্টা করব ।
Table of Contents
চুলের জন্য পেঁয়াজের রসের উপকারিতা
- অ্যালোপেসিয়া (চুল পড়া রোগ), পেঁয়াজের রসের মাধ্যমে চিকিৎসা করা যেতে পারে ( তথ্যসূত্র ) । এছাড়াও পেঁয়াজের রস চুলের বৃদ্ধিতে উপকারী ভুমিকা পালন করে ।
- এটি চুল এবং মাথার ত্বকে পুষ্টি সরবরাহ করে ।
- পেঁয়াজের রসে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণ রয়েছে, যা মাথার ত্বকের যে কোনও ধরণের সংক্রমণ প্রতিরোধ করে চুল পড়া বন্ধ করতে সহায়তা করে ( তথ্যসূত্র )।
- পেয়াজের রস সালফার সমৃদ্ধ, যা মাথার ত্বকে রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে নতুন চুলকে গোড়া থেকে শক্তিশালী করতে সাহায্য সাহায্য করে । এছাড়াও, সালফার চুলের মেইন উপাদান কেরাটিনের (হেয়ার প্রোটিন) জন্যও উপকারী হতে পারে।
- পেঁয়াজের রস চুলের ঘনত্ব বাড়াতেও সাহায্য করে ( তথ্যসূত্র ) ।
আরও পড়ুনঃ চুল থেকে খুশকি দূর করার উপায়
কীভাবে পেঁয়াজের রস চুলের জন্য ব্যবহার করবেন
পেঁয়াজের রস চুলের জন্য কীভাবে এবং কতটা উপকারী তা আপনারা এতক্ষনে জেনে গেছেন । এবার চলুন জেনে নেওয়া যাক, চুলের যত্নে পেঁয়াজের রস কীভাবে ব্যবহার করবেন ।
পেঁয়াজের রস – প্রথমে ২ চা চামচ পেঁয়াজের রস এবং তুলা নিন । এরপর পেঁয়াজের রসে তুলো ভাল করে ভিজিয়ে নিন ।
তারপর সেই তুলার সাহায্যে পেয়াজের রস আপনার মাথার ত্বকে লাগান । পেঁয়াজের রস আপনার পুরো মাথার ত্বকে লাগানোর পর, কিছুক্ষণ হালকা ভাবে আপনার মাথার ত্বক ম্যাসাজ করুন । এরপরে, এভাবে আপনি ২০ থেকে ৩০ মিনিট রেখে দিন ।
তারপর মাইল্ড শ্যাম্পু দিয়ে চুল ভাল করে ধুয়ে ফেলুন । আপনি সপ্তাহে ২ থেকে ৩ বার এটি প্রয়োগ করতে পারেন । পেঁয়াজের রস মাথার ত্বকের ব্লাড সার্কুলেশন উন্নত করে, চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে ( তথ্যসূত্র )। এছাড়াও এটি মাথার ত্বক এবং চুল সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা উপশম করতে পারে ( তথ্যসূত্র ) ।
পেঁয়াজের রস এবং নারকেল তেল – ২ চা চামচ পেঁয়াজের রস এবং ২ চা চামচ নারকেল তেল এবং ৫ ফোঁটা টি ট্রি অয়েল (খুশকি থাকলে) নিন । এরপর একটি পাত্র নিয়ে তাতে সবগুলো উপকরন একসাথে ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে মিশ্রণ তৈরি করুন ।
এবার এই পেয়াজ তেলের মিশ্রণটি আপনার মাথার ত্বকে লাগিয়ে কয়েক মিনিট ধরে ভাল করে ম্যাসাজ করুন । মিশ্রণটি আপনার পুরো মাথার ত্বকে ভালভাবে লাগিয়ে ৩০ মিনিট রেখে শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন । আপনি প্রতি সপ্তাহে ২ বার এই মিশ্রণ ব্যবহার করতে পারেন । নারকেল তেলের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা চুলকে উকুন এবং বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে ( তথ্যসূত্র ) । সেই সঙ্গে এতে উপস্থিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য চুলকে মজবুত করে এবং চুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে । অনেক সময় অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণেও চুল পড়া শুরু হয় । এমন পরিস্থিতিতে নারকেল তেলের অ্যান্টি-স্ট্রেস বৈশিষ্ট্য উপকারে আসতে পারে ।
পেঁয়াজের রস এবং মধু – দুই চামচ পেঁয়াজের রস এবং হাফ চা চামচ মধু একসাথে মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করুন । এবার এই মিশ্রণটি, আপনার মাথার ত্বকে লাগিয়ে ভালভাবে ম্যাসাজ করুন । এরপর এভাবে ৩০ মিনিট চুলে লাগিয়ে রেখে শ্যাম্পু দিয়ে চুল ভাল করে ধুয়ে ফেলুন । সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার এই মিশ্রণটি আপনার চুলে লাগান । মধু চুলকে ময়েশ্চারাইজ করতে সাহায্য করে । মধু, পেঁয়াজের রসের সাথে মিলিত হয়ে চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং চুলকে হাইড্রেটেড রাখে ।
পেঁয়াজের রস এবং লেবু – ১ চা চামচ পেঁয়াজের রস এবং ১ চা চামচ লেবুর রস ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে একটি মিশ্রণ প্রস্তুত করুন । এবার এই মিশ্রণটি আপনার মাথার ত্বকে লাগিয়ে ভালোভাবে ম্যাসাজ করুন । তারপর এভাবে ৩০ মিনিট রেখে মাইল্ড শ্যাম্পু দিয়ে চুল ভাল করে ধুয়ে ফেলুন । প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার এই মিশ্রণ আপনার মাথায় ইউজ করতে পারেন । লেবুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি, যা কোলাজেন তৈরি করতে সাহায্য করে । এটি আপনার চুলের ফলিকলগুলিকে শক্তিশালী করে এবং চুলকে স্বাস্থ্যকর করে তোলে । এছাড়াও এটি চুল থেকে খুশকি দূর করতে সাহায্য করে এবং চুলকে মজবুত করে তোলে ( তথ্যসূত্র )। লেবু আপনার মাথার ত্বকের পিএইচ লেভেলের ভারসাম্য বজায় রাখে এবং চুলের জন্য ঘরোয়া প্রতিকার হিসাবে কাজ করে ( তথ্যসূত্র ) ।
পেঁয়াজের রস এবং অলিভ ওয়েল – ৩ চা চামচ পেঁয়াজের রস এবং দেড় চামচ অলিভ অয়েল একটি পাত্রে নিয়ে ভাল করে মিশিয়ে নিন । এবার এই মিশ্রণটি আপনার মাথার ত্বকে লাগিয়ে দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করুন । এরপর শ্যাম্পু দিয়ে চুল ভাল করে ধুয়ে ফেলুন । আপনি প্রতি সপ্তাহে ২ দিন এই মিশ্রণ আপনার চুলে প্রয়োগ করতে পারেন । অলিভ অয়েল আপনার চুলকে স্বাস্থ্যকর এবং চকচকে করে তুলতে সাহায্য করে । এছাড়াও, এটি চুলকে নরম করে তুলতে পারে এবং চুলকে হাইড্রেট রাখে ( তথ্যসূত্র ) । অলিভ অয়েল এবং পেঁয়াজের রসের এই মিশ্রণ চুলকে মজবুত করে এবং চুলকে সুস্থ্য রাখতে সাহায্য করে ।
পেঁয়াজের রস এবং ডিম – ১ চামচ পেঁয়াজের রস এবং ১ টি ডিম, একটি পাত্রে নিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিন । এবার এই মিশ্রণটি আপনার মাথার ত্বক এবং চুলের গোঁড়া থেকে ডগা পর্যন্ত ভালো করে লাগান । মিশ্রণটি আপনার মাথার ত্বকে এবং চুলে ভালোভাবে প্রয়োগ করার পর একটি শাওয়ার ক্যাপ লাগিয়ে আধা ঘণ্টা রেখে দিন । তারপর সালফেট-মুক্ত শ্যাম্পু এবং ঠান্ডা পানি দিয়ে আপনার চুল ভাল করে ধুয়ে ফেলুন । প্রতি সপ্তাহে একবার থেকে দুবার এই মিশ্রণ আপনার চুলে প্রয়োগ করুন । এই মিশ্রণে ডিম এবং পেঁয়াজ থাকে যা প্রচুর পুষ্টিগুনে ভরপুর । ডিমে উপস্থিত প্রোটিন, বায়োটিন, ভিটামিন-বি এবং অন্যান্য পুষ্টি চুলকে ময়েশ্চারাইজ করে এবং চুলকে স্বাস্থ্যকর করে তুলতে সাহায্য করে ( তথ্যসূত্র ) । অন্যদিকে, পেঁয়াজের রস মাথার ত্বকে রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে চুলের দ্রুত বৃদ্ধি করে সাহায্য করে ( তথ্যসূত্র ) ।
পেঁয়াজের রস এবং আলু – ২ চামচ আলুর রস এবং এক চামচ পেঁয়াজের রস, একটি পাত্রে নিয়ে ভালভাবে মিশিয়ে নিন । এবার এই মিশ্রণটি আপনার মাথার ত্বকে লাগিয়ে ১০ মিনিট হালকা হাতে ম্যাসাজ করুন । তারপর এভাবে ২০ থেকে ৩০ মিনিট রেখে শ্যাম্পু করুন । আপনি সপ্তাহে ২ বার এই মিশ্রণ আপনার চুলে প্রয়োগ করতে পারেন । চুল, সুস্থ এবং ভাল রাখতে পুষ্টির প্রয়োজন । আলুতে রয়েছে পটাসিয়াম, ভিটামিন-সি এবং আয়রনের মতো পুষ্টি উপাদান, যা চুলকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে ( তথ্যসূত্র )।
পেঁয়াজের রস এবং ক্যাস্টর অয়েল – ২ চামচ ক্যাস্টর ওয়েল এবং দুই চামচ পেঁয়াজের রস ভালোভাবে মিশিয়ে নিন ।
এবার এই মিশ্রণটি দিয়ে আপনার মাথার ত্বকে কিছুক্ষন ম্যাসাজ করে এক ঘণ্টা রেখে দিন । তারপর শ্যাম্পু করুন । আপনি চাইকে প্রতি দিন এটি প্রয়োগ করতে পারেন । তবে, সপ্তাহে ২ থেকে ৩ বার এটি ব্যবহার করলে ভাল ফলাফল পাওয়া যায় । চুলের বৃদ্ধির জন্য ক্যাস্টর অয়েল খুব কার্যকরী । এটি চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং এর নিয়মিত ব্যবহারে চুল স্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে ( তথ্যসূত্র ) । আসলে, ক্যাস্টর অয়েলে রিসিনোলিক অ্যাসিড এবং ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, যা মাথার ত্বকে রক্ত সঞ্চালন উন্নত করতে সাহায্য করে । পেঁয়াজের রসের সাথে ক্যাস্টর অয়েল মিশিয়ে লাগালে চুল পড়া কমে যায় এবং চুল ঘন দেখায় ।
পেঁয়াজের রস এবং রসুন – এক চা চামচ রসুনের রস, এক চা চামচ পেঁয়াজের রস এবং এক চা চামচ অলিভ অয়েল ভাল করে মিশিয়ে নিন । এবার এই মিশ্রণটি আপনার মাথার ত্বকে লাগিয়ে হালকা হাতে কিছুক্ষন ম্যাসাজ করুন । এভাবে এক ঘণ্টা রেখে, শ্যাম্পু দিয়ে চুল ভাল করে ধুয়ে ফেলুন । আপনি সপ্তাহে ২ থেকে ৩ বার এই মিশ্রণ আপনার চুলে প্রয়োগ করতে পারেন । রসুন এবং পেঁয়াজের মিশ্রণ খাবারের স্বাদ বাড়ানোর পাশাপাশি, চুলের জন্যও অত্যন্ত উপকারী । NCBI ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, রসুনের তেল এবং বেটামেথাসোন ভ্যালেরেটের সংমিশ্রণ অ্যালোপেসিয়া এরিয়াটাতে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে ( তথ্যসুত্র )। এতে রয়েছে অনেক ধরনের পুষ্টি, যা চুলকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে । যখন রসুনকে পেঁয়াজের রসের সাথে যোগ করা হয়, তখন এর পুষ্টিগুণ আরও বেড়ে যায়, যা চুলকে গোঁড়া থেকে মজবুত করে এবং চুলের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে ।
দ্রষ্টব্য: উপরে উল্লিখিত উপাদানগুলিতে যদি কারও অ্যালার্জি থাকে, তাহলে সেই মিশ্রন ব্যবহার করা এড়িয়ে চলুন । এছাড়াও, এই প্রতিকারগুলি ইউজ করার আগে একটি প্যাচ টেস্ট করুন ।
আরও পড়ুনঃ অলিভ অয়েলের উপকারিতা এবং চুলের যত্নে অলিভ অয়েল
শেষ কথা
আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আপনারা নিশ্চই বুঝতে পেরেছেন যে, পেঁয়াজের রস চুলের জন্য কতটা উপকারী । এছাড়াও, আপনি, চুলের জন্য পেঁয়াজের রস কীভাবে ব্যবহার করতে হবে সেটাও জানতে পেরেছেন । ভাল এবং দ্রুত ফলাফল পাওয়ার জন্য, পেয়াজের রস সঠিকভাবে ব্যবহার করা প্রয়োজন । সুতরাং, আপনারা যদি, উপরের উল্লেখিত উপায়ে এটি ব্যবহার করেন, তাহলে কয়েক দিনের মধ্যেই পার্থক্য বুঝতে পারবেন । তাই আর দেরি না করে, আপনার চুলের ঘরোয়া প্রতিকারের তালিকায় পেঁয়াজের রস অন্তর্ভুক্ত করুন এবং আপনার চুলকে সুস্থ্য রাখুন । আর্টিকেলটি নিয়ে যে কোন ধরনের প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে কমেন্ট সেকশনে জানান । ধন্যবাদ