হাঁচি, কাশি এবং গলা ব্যথার সাথে উচ্চ জ্বরের মতো সমস্যাগুলি নিউমোনিয়ার লক্ষণ হতে পারে । যদি সঠিক সময়ে নিউমোনিয়ার চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে এই সংক্রামক রোগ মারাত্মক আকার ধারন করতে পারে । পরিবারের যদি কারো নিউমোনিয়া হয় তাহলে আরও বেশী সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে । কারণ সংক্রমণের কারণে রোগটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে । আজকের আর্টিকেলে আমরা নিউমোনিয়া কি ? নিউমোনিয়ার কারণ, লক্ষণ এবং ঘরোয়া প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব ।
Table of Contents
নিউমোনিয়া কি
নিউমোনিয়া হল এক ধরনের ফুসফুসের সংক্রমণ, যা সব বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে গুরুতর অসুস্থতার কারণ হতে পারে ( তথ্যসূত্র ) । এটি, আমাদের ফুসফুসের ক্ষুদ্র বায়ু থলি বা অ্যালভিওলি কে প্রভাবিত করে । যখন আমাদের নিউমোনিয়া হয়, তখন এই বায়ু থলি স্ফীত হয় এবং তরল দিয়ে পূর্ণ হয় । বায়ু থলি স্ফীত হওয়ার কারণে শ্বাস নিতে অসুবিধা হয় । নিউমোনিয়া ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং ছত্রাকের কারণে হয়ে থাকে । নিউমোনিয়া অনেক ধরনের সমস্যা তৈরি করতে পারে, যেমন- ফুসফুস ফুলে যাওয়া, পুঁজ ভর্তি হওয়া, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি । এছাড়াও এটি ২ বছরের কম বয়সী শিশু এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে ।
নিউমোনিয়ার প্রকারভেদ – নিউমোনিয়া কত প্রকার
অনেক ধরনের নিউমোনিয়া রয়েছে, তবে আমরা এখানে নিউমোনিয়ার কিছু বিশেষ প্রকারের কথা আপনাদের সাথে আলোচনা করব –
ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া: এই ধরনের নিউমোনিয়া, ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ছড়ায় । এর কারণে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সেই সাথে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও দুর্বল হয়ে যায় । আর এই দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে, ব্যাকটেরিয়া ফুসফুসে ইনফেকশন ঘটায় । পুষ্টির অভাব, বার্ধক্য বা দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে এই ধরনের নিউমোনিয়া মারাত্মক আকার ধারন করতে পারে । ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া সব ধরণের বয়সের মানুষের হতে পারে ।
ভাইরাল নিউমোনিয়া: ভাইরাল নিউমোনিয়া ফ্লু সহ অনেক ধরনের ভাইরাসের কারণে হতে পারে । এই ধরনের নিউমোনিয়া, তরুণ, বয়স্ক এবং যারা ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভুগছেন তাদের মধ্যে বেশী দেখতে পাওয়া যায় । ইনফ্লুয়েঞ্জা-এ এবং বি ভাইরাসগুলি তরুন এবং প্রাপ্তবয়স্কদের নিউমোনিয়ার প্রধান কারণ এবং শ্বাসযন্ত্রের সিনসিটিয়াল ভাইরাস (আরএসভি) হল শিশুদের ভাইরাল নিউমোনিয়ার মেইন কারণ ।
মাইকোপ্লাজমা নিউমোনিয়া: মাইকোপ্লাজমা (Mycoplasma) নিউমোনিয়া হল এক ধরনের ‘অ্যাটিপিকাল’ ব্যাকটেরিয়া, যা সাধারণত শ্বাসতন্ত্রের হালকা ইনফেকশন ঘটায় । এই ব্যাকটেরিয়াগুলি শিশুদের ট্র্যাচিওব্রঙ্কাইটিসের কারণ হতে পারে, যা সাধারণত বুকের ঠান্ডা হিসাবে পরিচিত । ক্লান্তি, গলা ব্যথা, জ্বর এবং কাশি মাইকোপ্লাজমা নিউমোনিয়ার প্রধান লক্ষণ । তবে Mycoplasma নিউমোনিয়া ফুসফুসের গুরুতর সংক্রমণ ঘটাতেও সক্ষম ।
ছত্রাকজনিত নিউমোনিয়া: এই ধরনের নিউমোনিয়া ছত্রাক দ্বারা সৃষ্ট হয়, যা মাটিতে বাস করে । সংক্রামিত ছত্রাকের সংস্পর্শে এসে মানুষ এই ধরনের নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হতে পারে । এটি সাধারণ ফ্লু-এর মতো উপসর্গ সৃষ্টি করতে পারে, যা সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে । ছত্রাকজনিত নিউমোনিয়ার প্রধান লক্ষণ গুলো হল – জ্বর, কাশি, মাথাব্যথা, ফুসকুড়ি, পেশী ব্যথা, জয়েন্টে ব্যথা ইত্যাদি ।
আরও পড়ুনঃ ব্লু লাইট কি ? ব্লু লাইট চোখের জন্য কতটা বিপজ্জনক?
নিউমোনিয়ার কারণ – নিউমোনিয়া কেন হয়
নিউমোনিয়া হওয়ার কিছু কারণ নিচে দেওয়া হল –
হিউম্যান মেটাপাইরোভাইরাস (HMPV): এটি শিশু থকে বৃদ্ধ সব বয়সের মানুষের শ্বাসযন্ত্রের রোগের কারণ হতে পারে । তবে, একদম অল্পবয়সী শিশু এবং যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল তাদের ক্ষেত্রে এই ধরনের নিউমোনিয়া সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি দেখা যায় ।
হিউম্যান প্যারাইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস (HPIV): সাধারণত নবজাতক, ছোট শিশু এবং দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যাদের, তারা এই ভাইরাস দ্বারা সহজেই আক্রান্ত হয় । এই ভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত হলে, এর লক্ষণগুলি ২ থেকে ৭ দিন পরে দেখা যায় ।
ইনফ্লুয়েঞ্জা (ফ্লু): এই ধরনের নিউমোনিয়া ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে । ফ্লুর মারাত্মক পরিণতির কারণে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে । ইনফ্লুয়েঞ্জা বয়স্ক, ছোট শিশু বা নবজাতক এবং শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশী দেখা যায় ।
Legionnaires’ disease and Pontiac fever: এটি নিউমোনিয়ার একটি গুরুতর এবং মারাত্মক রূপ, যা Legionella নামক ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যেম হয়ে থাকে । যখন মানুষ কুয়াশার মধ্যে শ্বাস নেয় বা দুর্ঘটনাক্রমে লেজিওনেলা দ্বারা সংক্রামিত পানি পান করে, তখন মানুষ এই ধরনের নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয় ।
মাইকোপ্লাজমা নিউমোনিয়া: মাইকোপ্লাজমা হল এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া । যা গলা, ফুসফুস, শ্বাসনালীর ক্ষতি করে নিউমোনিয়া তৈরি করতে পারে ।
নিউমোকোকাল রোগ: নিউমোকোকাল হল স্ট্রেপ্টোকক্কাস নিউমোনিয়া ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট ইনফেকশন, যা নিউমোকোকাস নামেও পরিচিত । এর কারণে কানের ইনফেকশন, মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ডের সংক্রমণ সহ বিভিন্ন ধরনের রোগ হতে পারে । শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের নিউমোকোকাল রোগ প্রতিরোধের জন্য ভ্যাক্সিন দেওয়া হয় ।
নিউমোসিস্টিস নিউমোনিয়া (পিসিপি): নিউমোসিস্টিস জিরোভেসি নামক ছত্রাক দ্বারা সৃষ্ট সংক্রমণকে নিউমোসিস্টিস নিউমোনিয়া (পিসিপি) বলা হয় । এর কারণে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং আপনি ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট বিভিন্ন ধরণের সংক্রমণের মাধ্যমে অসুস্থ হতে পারেন ।
রেসপিরেটরি সিনসাইটিয়াল ভাইরাস: রেসপিরেটরি সিনসাইটিয়াল হল একটি কমন শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাস, যা সাধারণত ঠান্ডার মতো উপসর্গ তৈরি করে । বেশিরভাগ মানুষ ১ বা ২ সপ্তাহের মধ্যে পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে ওঠে, তবে এটি শিশুদের ক্ষেত্রে গুরুতর হয়ে উঠতে হতে পারে ।
রাইনোভাইরাস: রাইনোভাইরাস হাঁপানির সমস্যা বাড়াতে পারে এবং সেই সাথে সাইনাস এবং কানের সংক্রমণও ঘটাতে পারে ।
নিউমোনিয়ার লক্ষণ – নিউমোনিয়ার উপসর্গ
নিউমোনিয়া হওয়ার কারণ জানার পর এখন আমরা জেনে নিই নিউমোনিয়ার লক্ষণগুলো কী কী –
- ঠান্ডা লাগার সাথে সাথে উচ্চমাত্রার জ্বর
- কফ সহ দীর্ঘস্থায়ী কাশি
- নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হওয়া বা শ্বাসকষ্ট
- শ্বাস বা কাশির সময় বুকে ব্যথা
- সর্দি বা ফ্লুর পরে স্বাস্থ্যের হঠাৎ অবনতি
নিউমোনিয়ার ঘরোয়া প্রতিকার
নিউমোনিয়ার কারণ এবং লক্ষণগুলি অনুসরণ করে নিউমোনিয়ার সমস্যা কমাতে ঘরোয়া প্রতিকারগুলি ব্যবহার করতে পারেন-
হলুদ দুধ – এক গ্লাস হালকা গরম দুধের সাথে ১ চিমটি হলুদ গুঁড়ো ভালোভাবে মিশিয়ে নিন । তারপর ধীরে ধীরে এই হলুদ দুধের মিশ্রণটি পান করুন । প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে এই হলুদ দুধ পান করুন । নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় হলুদ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । হলুদে কারকিউমিন নামক এক ধরনের বিশেষ উপাদান রয়েছে । এর অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি, ইমিউনোমোডুলেটরি এবং অ্যান্টিবায়োটিক বৈশিষ্ট্য নিউমোনিয়া দ্বারা সৃষ্ট ফুসফুসের ইনফেকশন কমাতে কার্যকরী ভুমিকা পালন করে ।
আদা – এক কাপ গরম পানির সাথে কয়েক টুকরো আদা মিশিয়ে ৫ থেকে ১০ মিনিট ভাল করে ফুটিয়ে নিন । স্বাদের জন্য আপনি এই মিশ্রণের সাথে মধু যোগ করতে পারেন । এবার এই আদা মিশ্রিত পানীয়টি ধীরে ধীরে সেবন করুন । এছাড়াও আপনি চা এর সাথে আদা মিশিয়ে আদা চা বানিয়ে সেবন করতে পারেন । নিউমোনিয়ার ঘরোয়া প্রতিকারের মধ্যে আদাও অন্তর্ভুক্ত । একটি গবেষণায় দেখা গেছে, আদার নির্যাস নিউমোনিয়ার প্রভাব কমাতে সক্ষম । এটি মানুষকে নিউমোনিয়া থেকে দ্রুত সুস্থ্য করে তুলতে পারে । এটি শ্বাসনালীকে মসৃণ করে পেশীগুলিকে শিথিল করে শ্বাসকষ্টের উপসর্গ থেকে মুক্তি দিতে পারে ।
মেথি বীজ – এক গ্লাস পানিতে ১ চামচ মেথি বীজ মিশিয়ে ১০ মিনিট ফুটিয়ে নিন ।এর পর মিশ্রণটি ছেঁকে নিয়ে তাতে স্বাদমতো মধু যোগ করে হালকা গরম থাকা অবস্থায় চায়ের মত পান করুন । নিউমোনিয়ার সমস্যা থাকা অবস্থায় এই মিশ্রণটি আপনি দিনে দুই বা তিনবার খেতে পারেন । নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় ঘরোয়া প্রতিকার হিসেবে মেথি বীজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লক্ষ্য করা যায় । প্রকৃতপক্ষে, মেথি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে নিউমোনিয়ার বিভিন্ন উপসর্গ যেমন সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, ব্রঙ্কিয়াল এবং গলা ব্যথা কমাতে সাহায্য করে ।
তিল বীজ – একটি পাত্রে পানি নিয়ে তাতে ১ চামচ তিল দিন এবং ৫ মিনিট ভাল করে ফুটিয়ে নিন । এর পরে তিল বীজ গুলোকে ছেঁকে আলাদা করে নিয়ে পানির সাথে হালকা লবণ এবং স্বাদমত মধু যোগ করে হালকা গরম অবস্থায় পানীয়টি সেবন করুন ।
দিনে একবার এই তিলের পানি খেতে পারেন । নিউমোনিয়া চিকিৎসায় তিলের বীজ অত্যন্ত কার্যকরী । তিলে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে, যা শ্বাসযন্ত্রের স্বাস্থ্যের উন্নতি করে নিউমোনিয়া কমাতে সাহায্য করতে পারে ।
তুলসী – প্রতিদিন দিনে দুই বা তিনবার কয়েকটি তুলসি পাতা চিবিয়ে খান । এছাড়াও তুলসি পাতা ভাল করে পিসে নিয়ে তা থেকে রস বের করে মধুর সাথে মিশিয়ে পান করুন । তুলসী পাতা খেলে নিউমোনিয়ার সমস্যায় অনেক উপকার পাওয়া যায় । একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, তুলসীর অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রভাব, নিউমোনিয়া সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সক্ষম । তাই বলা যায় তুলসি পাতা নিউমোনিয়া থেকে মুক্তি দিতে পারে ।
সবজির রস – নিউমোনিয়ার আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা হিসেবে সবজির রস খুব ভাল কাজ করে । গবেষণায় দেখা গেছে যে, ভিটামিন-এ নিউমোনিয়ার ইনফেকশন থেকে রক্ষা করতে পারে । শরীরে ভিটামিন-এ সরবরাহের জন্য টমেটো, গাজর, ব্রকলি, পালং শাক ইত্যাদি সবজির রস বানিয়ে পান করুন ।
ভিটামিন সি – ভিটামিন-সি নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় কার্যকর বলে মনে করা হয় । এটি একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা নিউমোনিয়া নিরাময়ে কার্যকরী ভুমিকা পালন করে । তাই নিউমোনিয়ার সমস্যা হলে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার বা পরিপূরক গ্রহণ করুন । তবে নিউমোনিয়ার জন্য আপনি যদি ভিটামিন সি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে চান তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন ।
মধু – আধা কাপ হালকা গরম পানির সাথে ১ চা চামচ খাঁটি মধু মিশিয়ে নিয়ে প্রতিদিন পান করুন । নিউমোনিয়ার ঘরোয়া প্রতিকার হিসেবে মধু অত্যন্ত কার্যকরী । এনসিবিআই (ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি গবেষণায় এই বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে । গবেষণা অনুসারে, মধুর ব্যাকটেরিয়ারোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা স্টেনোট্রোফোমোনাস ম্যালটোফিলিয়া নামক ব্যাকটেরিয়াকে প্রতিরোধ করে নিউমোনিয়ার উপসর্গ কমাতে পারে ।
রসুন – আপনি প্রতিদিন ২ বা ৩ কোয়া কাঁচা রসুন চিবিয়ে খান বা আপনি আপনার প্রতিদিনের রান্নায় রসুন যোগ করতে পারেন । এছাড়াও রসুনের কয়েকটি কোয়া বেটে নিয়ে পেস্ট তৈরি করে আপনার বুকে লাগান । নিউমোনিয়ার সমস্যা থাকা অবস্থায় আপনি দিনে একবার এই রসুনের পেস্ট আপনার বুকে ব্যবহার করতে পারেন । নিউমোনিয়ার ঘরোয়া প্রতিকার হিসেবে রসুন আপনার জন্য উপকারী হতে পারে । রসুনের নির্যাসের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল প্রভাব রয়েছে, যা নিউমোনিয়া ইনফেকশনের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে পারে । এইভাবে, রসুন নিউমোনিয়া থেকে মুক্তি দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
আপেল সিডার ভিনেগার – ১ গ্লাস হালকা গরম পানির সাথে আধা চামচ আপেল সিডার ভিনেগার এবং আধা চা চামচ মধু ভালো করে মিশিয়ে নিয়ে পান করুন । ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে আপের সিডার কার্যকরী ভুমিকা পালন করে । আপের সিডার ভিনেগারের অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্যে রয়েছে যা ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে নিউমোনিয়ার সমস্যা কমাতে খুব ভাল কাজ করে । এর ভিত্তিতে বলা যায় যে, আপেল সিডার ভিনেগার নিউমোনিয়ার ঘরোয়া প্রতিকার হিসেবে খুব ভাল কাজ করে ।
পেপারমিন্ট অয়েল – অলিভ অয়েল বা বাদাম তেলের সাথে কয়েক ফোঁটা পেপারমিন্ট অয়েল ভাল করে মিশিয়ে নিয়ে আপনার বুকে এবং পিঠে লাগান । দিনে একবার বা দুইবার এইভাবে পেপারমিন্ট অয়েল ব্যবহার করুন । পেপারমিন্ট অয়েল নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় কার্যকরী ভুমিকা পালন করে । একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, পুদিনার অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণ রয়েছে, যা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট ইনফেকশন কমিয়ে নিউমোনিয়ার উপসর্গ কমাতে সাহায্য করে ।
আপেল – নিউমোনিয়ার সমস্যা থাকাকালীন প্রতিদিন কমপক্ষে একটি করে আপেল খান । এছাড়াও আপনি আপেলের রস বের করে জুস করেও খেতে পারেন । নিউমোনিয়া থেকে দ্রুত মুক্তি পেতে আপেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে । আপেল ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ, যা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল হিসেবে কাজ করে নিউমোনিয়ার সমস্যা কমাতে পারে ।
গাজর – প্রতিদিন ২ বা ৩ টি গাজর খান । আপনি চাইলে গাজরের রস বা জুস করেও খেতে পারেন । নিউমোনিয়ার সমস্যা কমাতে গাজরের উপকারিতা দেখা যায় । একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, গাজরের মধ্যে প্রোবায়োটিক প্রভাব রয়েছে, যা ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে নিউমোনিয়ার সমস্যা কমাতে সাহায্য করতে পারে ।
কর্পূর তেল – এক চা চামচ অলিভ অয়েলের সাথে দুই তিন ফোঁটা কর্পূর তেল ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে আপনার বুকে এবং পিঠে হালকাভাবে ঘষুন । প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে এই কর্পূর তেলের মিশ্রণটি ইউজ করতে পারেন । নিউমোনিয়ার আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা হিসেবে কর্পূর খুব ভাল কাজ করে । NCBI-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্পূর তেলের শক্তিশালী অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য নিউমোনিয়ার উপসর্গ কমাতে পারে ।
স্টিমিং – একটি পাত্রে গরম পানি নিন এবং তার উপর আপনার মাথা নিচু করুন । এরপর একটি তোয়ালে দিয়ে আপনার মাথা ঢেকে সেই গরম বাষ্প শ্বাসের মাধ্যমে টেনে নিন । আপনি এই গরম পানির সাথে মেন্থল যোগ করতে পারেন । এই প্রতিকার দিনে ২ থেকে ৩ বার করা যেতে পারে । স্টিম ইনহেলেশন নিউমোনিয়ার সমস্যা কমাতে সক্ষম । এটি শ্বাসযন্ত্রের ইনফেকশন থেকে মুক্তি দিতে পারে, যা নিউমোনিয়ার অবস্থার উন্নতিতেও সাহায্য করতে পারে ।
আরও পড়ুনঃ উচ্চ রক্তচাপ কি ? উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ, চিকিৎসা এবং ঘরোয়া প্রতিকার
নিউমোনিয়ার চিকিৎসা
নিউমোনিয়ার চিকিৎসা কি ধরনের হবে, তা নির্ভর করে নিউমোনিয়ার ধরনের উপর । ঘরোয়া প্রতিকার গুলোর মাধ্যমে নিউমোনিয়ার চিকিৎসা হবে এমনটা না ভেবে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহন করুন এবং নিউমোনিয়ার সঠিক চিকিৎসা নিন । পাশাপাশি ঘরোয়া প্রতিকারগুলো অনুসরন করুন ।
1. ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া: ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে ডাক্তার নির্ধারিত কিছু অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করে থাকেন । বেশিরভাগ মানুষ ওষুধ শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই সুস্থ্য অনুভব করতে শুরু করতে পারেন, কিন্তু তারপরেও ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধের ফুল ডোজ কমপ্লিট করা উচিত ( তথ্যসূত্র )। কারণ ডোজ কমপ্লিট হওয়ার আগে ওষুধ বন্ধ করলে নিউমোনিয়া ফিরে আসতে পারে । বেশিরভাগ মানুষ ওষুধ সেবনের এক থেকে তিন দিনের মধ্যে ভাল বোধ করতে শুরু করে ।
2. ভাইরাল নিউমোনিয়া: যদি আপনি ভাইরাল নিউমোনিয়া দ্বারা আক্রান্ত হন, তাহলে ডাক্তার এটির চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ সাজেস্ট করতে পারেন । ভাইরাল নিউমোনিয়া সাধারণত ১ থেকে ৩ সপ্তাহের মধ্যে ভাল হয়ে যায় । যাদের গুরুতর লক্ষণ থাকে তাদের নিউমোনিয়ার চিকিৎসার জন্য হসপিটালে ভর্তির প্রয়োজন হতে পারে । এই কারণে, নিউমোনিয়ার লক্ষণগুলি দেখা যাওয়ার সাথে সাথে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসা করানো উচিত ।
3. মাইকোপ্লাজমা নিউমোনিয়া: এই ধরনের নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহার করা হয় । এই ধরনের নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে ডাক্তাররা, শিশু এবং যুবকদের জন্য বিভিন্ন ধরণের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ লিখে দিতে পারেন । তবে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোন অবস্থাতেই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহার করবেন না ।
4. ফাঙ্গাল নিউমোনিয়া: এই ধরনের নিউমোনিয়ার চিকিৎসার জন্য ডাক্তার প্রধানত অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ওষুধ সাজেস্ট করেন । কারণ এই ধরনের নিউমোনিয়া ছত্রাকের কারণে তৈরি হয় ।
আসুন এখন জেনে নিই নিউমোনিয়ায় কী খাবেন এবং কী এড়িয়ে চলতে হবে।
নিউমোনিয়ায় ডায়েট – কী খাবেন এবং কী খাবেন না
নিউমোনিয়া হলে আপনার খাবারের তালিকায় ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ খাবার কে স্থান দিন । আপনারা আপনাদের খাবার তালিকায় নিচের খাবারগুলো অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন –
আমাদের কি খাওয়া উচিত –
- কমলালেবু, লেবু, মালটা, আঙ্গুর, কিউই ফল, আম এবং পেঁপে খেতে পারেন ।
- আনারস, স্ট্রবেরি, রাস্পবেরি, ব্লুবেরি, ক্র্যানবেরি এবং তরমুজ খান।
- ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ হার্বাল চা এবং স্যুপ খেতে পারেন । এগুলোর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টিবায়োটিক বৈশিষ্ট্যও রয়েছে, যা নিউমোনিয়ার সমস্যা কমাতে সাহায্য করতে পারে ।
কি খাবেন না:
নিচে উল্লেখিত খাবারগুলো শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের কারণ হতে পারে এবং নিউমোনিয়ার সময় নেতিবাচক প্রভাব দেখাতে পারে ।
- রান্না করা ঠান্ডা মাংস
- লবণ
- দুগ্ধজাত পণ্য
- ভাজা খাবার
- কার্বনেটেড ঠান্ডা পানি বা সফট ড্রিঙ্কস
- অ্যাসিডিক খাবার এবং পানীয়
নিউমোনিয়ার ঝুঁকির কারণ
নিউমোনিয়া নির্দিষ্ট বয়স এবং বিশেষ অবস্থার মানুষদের মধ্যে আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে । তাই চলুন নিউমোনিয়ার ঝুঁকির কারণগুলি জেনে নেওয়া যাক ।
- দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষ ।
- সিগারেট এবং অ্যালকোহলের অত্যধিক ব্যবহার।
- যারা ভুল ওষুধ ব্যবহার করেন তাদেরও নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে ।
- দুই বছরের কম বয়সী এবং ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের ক্ষেত্রে এই রোগের ঝুঁকি বেশী থাকে ।
- রাসায়নিক, দূষণ বা বিষাক্ত ধোঁয়ার এক্সপোজার।
নিউমোনিয়া প্রতিরোধের উপায় – নিউমোনিয়া প্রতিরোধের টিপস
নিউমোনিয়া রোগের প্রতিরোধ সম্পর্কে জানা অত্যন্ত জরুরী । কিছু সহজ পদ্ধতি অবলম্বন করে নিউমোনিয়া থেকে দূরে থাকা যায় । তাহলে চলুন নিউমোনিয়া প্রতিরোধ সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক –
- ধূমপান থেকে বিরত থাকুন, কারণ এটি আপনার শ্বাসযন্ত্রকে দুর্বল করে ফেলে । যার ফলে আপনার শ্বাসযন্ত্র সংক্রমণের জন্য সংবেদনশীল হয়ে ওঠে ।
- খাবারের আগে এবং পরে আপনার হাত ভাল করে সাবান এবং পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নিন ।
- সংক্রমণের বিস্তার রোধ করতে কাশি এবং হাঁচি দেওয়ার সময় আপনার নাক এবং মুখ যে কোন কিছু দিয়ে ঢেকে রাখুন ।
- আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে স্বাস্থ্যকর এবং পুষ্টিকর খাবার খান এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম নিন ।
নিউমোনিয়ার প্রতিরোধের জন্য ভ্যাকসিন রয়েছে, কিন্তু এগুলো সম্পূর্ণরূপে নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করতে সক্ষম না । তবে এগুলি অবশ্যই নিউমোনিয়ার ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হতে পারে । নিউমোনিয়ার জন্য এই রোগগুলির সাথে সম্পর্কিত টিকা গ্রহন করা যেতে পারে ।
- হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি (হিবি)
- ইনফ্লুয়েঞ্জা (ফ্লু)
- হাম
- Pertussis (হুপিং কাশি)
- নিউমোকোকাল
- ভ্যারিসেলা (চিকেনপক্স)
নিউমোনিয়ার জন্য আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস
যদি আপনি নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হন, তবে এর সংক্রমণ থেকে দ্রুত সুস্থ্য হতে এবং জটিলতা প্রতিরোধ করতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস অনুসরণ করতে পারেন –
- ডাক্তার দ্বারা নির্ধারিত সমস্ত ওষুধ সঠিক সময়ে গ্রহণ করুন এবং অবশ্যই ওষুধের সম্পূর্ণ ডোজ কমপ্লিট করুন ।
- নিউমোনিয়া পুরোপুরি ঠিক না হওয়া পর্যন্ত অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ চালিয়ে যান । মাঝপথে ওষুধ বন্ধ করে দিলে নিউমোনিয়া পুনরায় ফিরে আসতে পারে ।
- নিউমোনিয়া থেকে সেরে উঠতে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে । তাই আপনি কখন আপনার স্বাভাবিক রুটিনে পুনরায় ফিরে যাবেন সে সম্পর্কে আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলুন ।
- কোন ব্যক্তি নিউমোনিয়া আক্রান্ত হলে পরিবার ও বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ সীমিত করুন ।
- কাশি বা হাঁচির সময় আপনার নাক এবং মুখ কাপড় বা টিস্যু দিয়ে ঢেকে রাখুন। এবং দ্রুত ব্যবহৃত পোশাক এবং আপনার হাত ধুয়ে ফেলুন ।
শেষ কথা
নিউমোনিয়া এমন এক ধরনের সংক্রমণ, যা সময়মতো চিকিৎসা না করা হলে মারাত্মক আকার ধারন করতে পারে । এ কারণে শারীরিক সমস্যাগুলো সম্পর্কে সব সময় সচেতন থাকুন এবং নিজের ও পরিবারের সদস্যদের যত্ন নিন । এছাড়াও, যদি আপনি নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হন, তাহলে যতটা সম্ভব মানুষের সাথে যোগাযোগ থেকে দূরে থাকুন । আর্টিকেলটি নিয়ে যে কোন ধরনের প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে কমেন্ট সেকশনে জানান ।