পোলিও একটি মারাত্মক রোগ । অনেক দেশ এখনও এই রোগে ভুগছে । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পোলিওর ৯৯ শতাংশ নির্মূল করা হয়েছে, তবে এটি এখনও অনেক দরিদ্র দেশকে প্রভাবিত করে ( তথ্যসূত্র )। আমাদের বাংলাদেশকে পোলিও মুক্ত রাখতে প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে পোলিও টিকা দেওয়া হয় । এটি একটি গুরুতর রোগ, তাই এটি সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য জানা অত্যন্ত জরুরী ।এই কারণেই আজকের এই আর্টিকেলে, আমরা আপনাদের সাথে পোলিও সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য শেয়ার করার চেষ্টা করব ।আজকের এই আর্টিকেলে আপনারা পোলিও কি, পোলিওর ধরন এবং পোলিও এড়ানোর উপায় সম্পর্কে জানতে পারবেন । সেই সঙ্গে পোলিও টিকা এবং কীভাবে পোলিওর চিকিৎসা করা যায় তাও জানতে পারবেন ।
Table of Contents
পোলিও কি – পোলিও কাকে বলে
পোলিও বা পোলিওমাইলাইটিস হল এমন একটি রোগ, যা স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করে পক্ষাঘাত (পঙ্গু) ঘটাতে পারে ( তথ্যসূত্র )। পোলিও রোগের ভাইরাস একজন সংক্রামিত ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির কাছে যেতে পারে এবং সুস্থ্য ব্যক্তির মেরুদন্ডকে সংক্রামিত করতে পারে । যার ফলে পক্ষাঘাত ঘটতে পারে (পুরো শরীর বা শরীরের বিভিন্ন অংশ অচল হয়ে যেতে পারে ) ।বিশ্বজুড়ে পোলিও টিকা ব্যাপকভাবে ব্যবহারের পর পোলিওর প্রকোপ কমেছে, তবে এটি এখনও একটি প্রাণঘাতী রোগ । এ কারণে পোলিওর চিকিৎসা ও প্রতিরোধে যত্ন নেওয়া আবশ্যক ।
পোলিও কি তা জানার পর চলুন জেনে নেই পোলিওর প্রকারভেদ সম্পর্কে ।
পোলিওর ধরন – পোলিওর প্রকারভেদ – পোলিও কত প্রকার
পোলিওর ধরন সম্পর্কে কথা বললে, এটি দুই ধরনের হতে পারে –
- প্যারালাইটিক পোলিও : এতে, পোলিও ভাইরাস নির্দিষ্ট স্নায়ু তন্তুর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং মেরুদন্ডের সাথে মস্তিষ্কের অংশে (মস্তিষ্কের স্টেম এবং মোটর কর্টেক্স) মোটর নিউরনগুলিকে (কোষ যা অপরিহার্য পেশী চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে) আক্রমন করে এবং সেগুলোর ক্ষতিসাধন করে । যেমন কথা বলার ক্ষতি । এই ক্ষতি প্যারালাইটিক পোলিওমাইলাইটিস তৈরি করে । নিউরনের ক্ষতির উপর ভিত্তি করে প্যারালাইটিক পোলিওর প্রকারগুলিকে ৩ প্রকারে ভাগ করা যায় –
- স্পাইনাল পোলিও : এই ধরনের পোলিও ভাইরাস মেরুদন্ডে উপস্থিত মোটর নিউরনকে প্রভাবিত করে । ভাইরাস, আক্রান্ত স্থানের পেশীগুলিকে দুর্বল এবং অবশ করে দিতে পারে ।
- বুলবার পোলিও : এই ধরনের পোলিও ভাইরাস মস্তিষ্কের বুলবার অংশকে আক্রমন করে (ব্রেনস্টেম এবং সেরিবেলামকে সংযুক্ত করে) । ভাইরাসটি বুলবার অংশের স্নায়ুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা শ্বাস নেওয়া, কথা বলা এবং যে কোন কিছু গিলতে বাধা প্রদান করে ।
- বুলবোস্পাইনাল পোলিও : প্যারালাইটিক পোলিওর প্রায় ১৯ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগী বুলবোস্পাইনাল পোলিওতে ভোগেন ।এই ধরনের ক্ষেত্রে, মেরুদণ্ড এবং বুলবার উভয়ই পোলিওভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় । এই সময় একজন ব্যক্তির ভেন্টিলেটর ছাড়া শ্বাস নিতে সমস্যা হয় । সেই সাথে আক্রান্ত ব্যক্তির বাহু ও পায়ে প্যারালাইসিস হতে পারে এবং হার্টের কার্যকারিতা ব্যাহত হতে পারে ।
- প্যাথোফিজিওলজি : এই ধরনের পোলিওতে পোলিও ভাইরাস মুখ দিয়ে শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে । শরীরে প্রবেশ করার পরে, এটি প্রথমে ফ্যারিনক্সের কোষগুলি (ফ্যারিনক্স – গলার একটি অংশ) এবং অন্ত্রের মিউকোসাকে সংক্রামিত করে । এই ভাইরাস কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে আরও প্রভাবিত করতে পারে এবং শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে ।
পোলিওর কারণ – পোলিও রোগের কারণ – পোলিও রোগ কেন হয়
পোলিও ভাইরাস হল পোলিও রোগের প্রধান কারণ । এই রোগের বিস্তারের অনেক কারণ থাকতে পারে, যা পোলিও রোগের কারণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, যেমন ( তথ্যসূত্র ):
- সংক্রামিত ব্যক্তির সাথে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে
- নাক এবং মুখ থেকে সংক্রামিত শ্লেষ্মার মাধ্যমে
- সংক্রামিত ব্যক্তির মলের মাধ্যমে
আর্টিকেলের পরবর্তী অংশে, আমরা আপনাদের পোলিও রোগের লক্ষণ সম্পর্কে বলব ।
আরও পড়ুনঃ ডেঙ্গু জ্বর কী ? ডেঙ্গু জ্বরের কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা এবং ঘরোয়া প্রতিকার
পোলিওর লক্ষণ – পোলিও রোগের লক্ষণ – পোলিও রোগের লক্ষণ কি
পোলিও রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাধারণত কোনো উপসর্গ দেখা যায় না, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পোলিও রোগের উপসর্গ সাধারণ ফ্লুর মতোই । এই লক্ষণগুলি প্রায় ২ থেকে ৫ দিন স্থায়ী হয় এবং তারপর অদৃশ্য হয়ে যায়, যেমন –
- গলা ব্যথা
- জ্বর
- ক্লান্তি
- বমি বমি ভাব
- মাথাব্যথা
- পেটে ব্যথা
এগুলি ছাড়াও, কিছু ক্ষেত্রে পোলিওর লক্ষণগুলি গুরুতর হয়ে ওঠে এবং কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে (মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ড) প্রভাবিত করতে শুরু করে । এই ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে কিছু গুরুতর উপসর্গ দেখা যায় –
- প্যারেস্থেসিয়া – পায়ে পিন এবং সূঁচের মতো অনুভূতি
- মেনিনজাইটিসের লক্ষণ – মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ডের সংক্রমণ
- পক্ষাঘাত বা প্যারালাইসিস
প্রতিটি শারীরিক সমস্যার মতো, পোলিও রোগ হওয়ার কিছু ঝুঁকির কারণ রয়েছে, যা এটি হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে । নিচে সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হল –
পোলিওর ঝুঁকির কারণ – পোলিও রোগের ঝুঁকির কারণ
পোলিও ভাইরাসের কারণ ছাড়াও, কিছু ঝুঁকির কারণও রয়েছে, যা এই রোগের কারণ হতে পারে, যেমন –
- পোলিও টিকা গ্রহন না করা
- পোলিও আক্রান্ত এলাকায় ভ্রমণ
- অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসকারী শিশু
পোলিওর চিকিৎসা – পোলিও রোগের চিকিৎসা
এই বিভাগের শুরুতে, আমরা আপনাদের বলে রাখি যে, পোলিও রোগ নিরাময়ের কোন কার্যকরী চিকিৎসা নেই । নিম্নলিখিত চিকিৎসাগুলো শুধুমাত্র পোলিও রোগের লক্ষণগুলি কিছুটা কমাতে সাহায্য করতে পারে –
- অ্যান্টিবায়োটিক : মূত্রনালীর সংক্রমণের লক্ষণগুলি কমাতে (মূত্রনালীর সংক্রমণ ) সাহায্য করে ।
- হিটিং প্যাড : পেশী ব্যথা এবং খিঁচুনি কমাতে সহায়তা করে ।
- ব্যথা উপশমকারী ঔষুধ : মাথাব্যথা, পেশী ব্যথা এবং ক্র্যাম্প কমাতে সাহায্য করে ।
- শারীরিক থেরাপি : পেশী শক্তি এবং পেশির কার্যকারিতা উন্নত করতে সাহায্য করে । সেই সাথে, কিছু গুরুতর ক্ষেত্রে অর্থোপেডিক সার্জারি করা যেতে পারে ।
পোলিওর চিকিৎসা সম্পর্কে বলার পর, নিবন্ধের পরবর্তী অংশে, আমরা আপনাদের পোলিও রোগ থেকে বাঁচার উপায় সম্পর্কে বলব ।
আরও পড়ুনঃ আমাশয়ের কারণ, লক্ষণ এবং ঘরোয়া প্রতিকার
পোলিও রোগ প্রতিরোধের উপায় – পোলিও প্রতিরোধের টিপস
যেহেতু পোলিও রোগের কোন কার্যকরী চিকিৎসা নেই, তাই পোলিও রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে ।
এই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলি হল পোলিও টিকা, যা নীচে উল্লেখ করা হল –
- ওরাল পোলিও ভ্যাকসিন : পোলিও প্রতিরোধের জন্য এই টিকা মুখের মধ্যে দেওয়া হয় । তবে এর কিছু নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে । মূলত, এই ভ্যাকসিনে লাইভ ভাইরাস উপস্থিত থাকে । বিরল ক্ষেত্রে, এই মৌখিক ভ্যাকসিন ‘টিকা থেকে প্রাপ্ত পোলিওভাইরাস’ পোলিও ঘটাতে পারে । এই কারণেই আমেরিকা এই ভ্যাকসিন নিষিদ্ধ করেছে, তবুও এটি অনেক দেশে গ্রহণ করা হচ্ছে ।
- নিষ্ক্রিয় পোলিওভাইরাস ভ্যাকসিন : এই ভ্যাকসিনটি ব্যক্তির বাহু বা পায়ে ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হয় । এই পোলিও টিকা একজন ব্যক্তিকে ৩ ধরনের পোলিও থেকে রক্ষা করে । এতে লাইভ ভাইরাস থাকে না, তাই এই পোলিও ভ্যাকসিন অন্য লোকেদের মধ্যে সংক্রমণ ঘটায় না ।
শেষ কথা
পোলিও রোগের ক্ষেত্রে এটা একেবারেই সত্য যে, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম । পোলিও রোগের কোন কার্যকরী চিকিৎসা না থাকায়, এটি প্রতিরোধের জন্য সঠিক সময়ে পোলিও টিকা গ্রহন করা প্রয়োজন । আমাদের বাংলাদেশে পোলিও রোগ প্রায় নেই বললেই চলে, কিন্তু তারপরেও আমাদের দেশকে পোলিও মুক্ত রাখতে হলে নিয়মিত পোলিও টিকা দিতে হবে । আমরা আশা করছি যে, আজকের এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আপনারা পোলিওর কারণ, লক্ষণ এবং এর সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন । আর্টিকেলটি নিয়ে যে কোন ধরনের প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে কমেন্ট সেকশনে জানান । ধন্যবাদ