ফেনাযুক্ত প্রস্রাবের কারণ, লক্ষণ এবং চিকিৎসা

শরীরের অভ্যন্তরীণ কোন সমস্যা থাকলে, মানুষের প্রস্রাবের রং ও গন্ধের পরিবর্তন হয় । আবার অনেক সময় প্রস্রাব করার পর ফেনা হতে দেখা যায় । এমন অবস্থায় প্রথমেই আতঙ্কিত হওয়ার দরকার নেই, কারণ কিছু ক্ষেত্রে প্রস্রাবে ফেনা স্বাভাবিক কারণে হতে পারে । আজকের এই আর্টিকেলে আমরা আপনাদের সাথে, ফেনাযুক্ত প্রস্রাবের কারণ, ফেনাযুক্ত প্রস্রাবের লক্ষণ এবং ফেনাযুক্ত প্রস্রাবের চিকিৎসা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব ।

ফেনাযুক্ত প্রস্রাবের কারণ – ফেনাযুক্ত প্রস্রাব কেন হয়

ফেনাযুক্ত প্রস্রাবের সবচেয়ে কমন কারণ হল অতিরিক্ত জোরে প্রস্রাব করা । এছাড়াও প্রস্রাবে ফেনা হওয়ার আরও কিছু কারণ থাকতে পারে, যেগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো –

1. ডিহাইড্রেশন- প্রস্রাবে ফেনা হওয়ার আরও একটি অন্যতম কারণ হতে পারে, শরীরে পানির অভাব । যখন শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি থাকে না অর্থাৎ যখন শরীরে পানি ঘাটতি দেখা দেয়, তখন প্রস্রাব আরও বেশী ঘনীভূত হয়, যার ফলে প্রস্রাবের সাথে ফেনা হতে দেখা যায় ।

2. প্রস্রাবের সাথে প্রোটিন বের হলে- যখন শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে অ্যালবুমিনের মতো প্রোটিন প্রস্রাবের সাথে বের হতে শুরু করে, তখন প্রস্রাবে ফেনা তৈরি হয় । মূলত, প্রস্রাবের মধ্যে থাকা প্রোটিন, বাতাসের সাথে বিক্রিয়া করে ফেনা তৈরি করতে পারে (তথ্যসূত্র) ।

3. কিডনির সমস্যা- কিডনি আমাদের শরীরের রক্ত ​​থেকে, অতিরিক্ত পানি এবং বর্জ্য পদার্থকে ফিল্টার করে এবং প্রস্রাবের মাধ্যমে তা শরীর থেকে বাইরে বের করে দেয় । এই ফিল্টারের সময়, প্রোটিন এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান রক্তে থেকে যায় । কিন্তু যখন কিডনিতে কোন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়, তখন কিডনি সঠিকভাবে ফিল্টার করতে পারে না । এর ফলে প্রস্রাবের সাথে অতিরিক্ত প্রোটিন বের হয়ে যেতে পারে, যা প্রোটিনুরিয়া নামেও পরিচিত । এটি এক প্রকারের দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের লক্ষণ (তথ্যসূত্র) ।

4. রেট্রোগ্রেড ইজাকুলেশন- এটি শুধুমাত্র পুরুষদের সমস্যা । প্রচণ্ড উত্তেজনার সময় বীর্য পুরুষাঙ্গ দিয়ে বের হওয়ার পরিবর্তে মূত্রাশয়ে প্রবেশ করলে রেট্রোগ্রেড ইজাকুলেশন হয় । (তথ্যসূত্র) ।

5. Amyloidosis- এমন অবস্থা খুব কম সময়ে দেখা যায় । এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ফেনাযুক্ত প্রস্রাব এবং কিডনির সমস্যা হতে পারে । এটি একটি নির্দিষ্ট ধরণের প্রোটিনের কারণে হয়, যা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গকে প্রভাবিত করতে পারে (তথ্যসূত্র) ।

6. নেফ্রোটিক সিনড্রোম- শরীরের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন অঙ্গ এই সমস্যা দ্বারা প্রভাবিত হয়, যার মধ্যে একটি হল কিডনি । এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রস্রাবেও ফেনা দেখা যায় (তথ্যসূত্র) ।

7. ডায়াবেটিসের সমস্যা- ডায়াবেটিসের কারণে শরীরে অনেক রকমের পরিবর্তন দেখা যায় । এই পরিবর্তনগুলির মধ্যে একটি হল ফেনাযুক্ত প্রস্রাব (তথ্যসূত্র) । তবে সব ডায়াবেটিস রোগীর ফেনাযুক্ত প্রস্রাব হয় না ।

আরও পড়ুনঃ ডায়েট বা ব্যায়াম ছাড়া ওজন কমানোর উপায়

ফেনাযুক্ত প্রস্রাবের লক্ষণ

ফেনাযুক্ত প্রস্রাবের লক্ষণগুলি ছোট ছোট বুদবুদের আকারে দেখা যেতে পারে এবং সেই সাথে প্রস্রাবের রঙের পরিবর্তন হতে পারে (তথ্যসূত্র) । একই সাথে, ফেনাযুক্ত প্রস্রাবের সমস্যা নেফ্রোটিক সিনড্রোমের সাথেও যুক্ত । এমতাবস্থায় ফেনাযুক্ত প্রস্রাবের লক্ষণ নিচে দেওয়া হল –

  • ক্ষুধা কমে যাওয়া
  • হাত, পা, পেট এবং মুখ ফুলে যাওয়া ।
  • ক্লান্তি আনুভব করা
  • মাথাব্যথা
  • চুলকানি এবং শুষ্ক ত্বক
  • ওজন কমে যাওয়া
  • ত্বকের রঙে পরিবজাওয়
  • খুব বেশি তৃষ্ণা অনুভব হওয়া
  • শ্বাসকষ্ট
  • ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না

ফেনাযুক্ত প্রস্রাবের রোগ নির্ণয়

ফেনাযুক্ত প্রস্রাবের কারণ নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকরা নিচে উল্লেখিত পরিক্ষাগুলো দিতে পারেন –

1. শারীরিক পরীক্ষা- চিকিৎসকরা ব্যক্তির মধ্যে থাকা লক্ষণগুলি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে পারেন । চিকিৎসক আপনার জিহ্বা এবং চোখ পরীক্ষা করতে পারেন ।

2. প্রস্রাব পরীক্ষা- ফেনাযুক্ত প্রস্রাব সনাক্ত এবং এর কারণ জানার জন্য চিকিৎসক ইউরিন টেস্ট দিতে পারেন । এই পরীক্ষার সময় ইউরিনে প্রোটিনের পরিমাণ জানা যাবে । এই টেস্টে, প্রস্রাবের অ্যালবুমিন কে ক্রিয়েটিনিনের লেভেলের সাথে তুলনা করা হয়, যা প্রস্রাবের অ্যালবুমিন থেকে ক্রিয়েটিনিন অনুপাত (UACR) নামেও পরিচিত । এই অনুপাত দেখেই বোঝা যাবে যে, কিডনি সঠিকভাবে রক্ত ​​ফিল্টার করছে কি না । যদি UACR প্রতি গ্রামে 30 মিলিগ্রামের থেকে বেশি হয় তবে এটি কিডনির সমস্যা হতে পারে (তথ্যসূত্র) ।

3. প্রস্রাবের মধ্যে বীর্য পরীক্ষা- যদি ফেনাযুক্ত প্রস্রাবের পিছনে বীর্যপাতের সমস্যা রয়েছে বলে মনে করা হয়, তবে চিকিৎসক প্রস্রাবে বীর্য টেস্ট করতে পারেন (তথ্যসূত্র)

ফেনাযুক্ত প্রস্রাবের জন্য চিকিৎসা

ফেনাযুক্ত প্রস্রাবের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, এটি সম্পর্কিত সমস্যার চিকিৎসা করা প্রয়োজন । নীচে আমরা এই ফেনাযুক্ত প্রস্রাবের সমস্যা এবং চিকিৎসা সম্পর্কে আপনাদের সাথে আলোচনা করব –

1. কিডনির চিকিৎসা- যদি ফেনাযুক্ত প্রস্রাব, কিডনি সমস্যার কারণে হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে কিডনি সংক্রান্ত সমস্যার চিকিৎসা করা প্রয়োজন । এর জন্য, চিকিৎসক আপনাকে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ যেমন অ্যাঞ্জিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ইনহিবিটর বা অ্যাঞ্জিওটেনসিন রিসেপ্টর ব্লকার ব্যবহার করার পরামর্শ দিতে পারেন (তথ্যসূত্র) ।

2. নেফ্রোটিক সিনড্রোমের চিকিৎসা- টেস্টের রিপোর্ট দেখার পর যদি নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ফেনাযুক্ত প্রস্রাব নেফ্রোটিক সিনড্রোমের কারণে হচ্ছে, তাহলে নেফ্রোটিক সিনড্রোমের চিকিৎসা করা প্রয়োজন । এই রোগের চিকিৎসার জন্য ডাক্তার রক্তচাপের ওষুধ, কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ, মূত্রবর্ধক ওষুধ এবং রক্ত ​​পাতলা করার ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন (তথ্যসূত্র) ।

3. ডায়াবেটিসের চিকিৎসা- ডাক্তাররা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এমন ওষুধগুলি ফেনাযুক্ত প্রস্রাবের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করার পরামর্শ দিতে পারেন । আসলে ডায়াবেটিসের সমস্যার কারণেও প্রস্রাবে ফেনা হতে পারে (তথ্যসূত্র) । এমতাবস্থায় ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করে ফেনাযুক্ত প্রস্রাবের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় ।

নোট – যে কোন ধরনের ওষুধ সেবনের আগে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন ।

আরও পড়ুনঃ চা পানের উপকারিতা এবং অসুবিধা

ফেনাযুক্ত প্রস্রাবের ডায়েট

ফেনাযুক্ত প্রস্রাবের ক্ষেত্রে সুষম খাদ্য খাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । এছাড়াও, কিডনির ক্ষতি করে এমন ধরনের খাবার থেকে দূরে থাকা উচিত –

কি খাবেন

  • বেশী বেশী প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন মাংস, মাছ, ডিম এবং দুগ্ধজাত খাবার গ্রহণ করা যেতে পারে ।
  • শিম এবং শিমের বিচি
  • বাদাম
  • খাদ্যশস্য
  • সবজি
  • ফল
  • কম চর্বিযুক্ত দুধ, দই এবং পনির

কি খাবেন না –

  • অ্যালকোহল সেবন করা থেকে বিরত থাকুন
  • ধূমপান ও তামাক থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন
  • অতিরিক্ত মশলাদার এবং ভাজা খাবার এড়িয়ে চলুন
  • তৈলাক্ত খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন

ফেনাযুক্ত প্রস্রাবের ঝুঁকি ও জটিলতা

ফেনাযুক্ত প্রস্রাব উপেক্ষা করলে পরবর্তীতে অনেক ধরনের সমস্যা হতে পারে । কারণ এটি অনেক ধরনের শারীরিক সমস্যার লক্ষণ হতে পারে । এমতাবস্থায় নিজের বা পরিবারের কারো প্রস্রাবে ফেনা দেখা দিলে অবশ্যই একবার চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে সেই অনুযায়ী ওষুধ সেবন করুন । যদি আপনি সময়মত চিকিৎসা না করান তাহলে ভবিষ্যতে নিম্নলিখিত সমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে –

  • কিডনি ফেইলিওর
  • কার্ডিওভাসকুলার রোগ
  • দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ
  • নিউমোকোকাল নিউমোনিয়া
  • অপুষ্টি
  • শরিরে প্রোটিনের অভাব হতে পারে
  • ডায়াবেটিসের সমস্যা বাড়তে পারে

আসুন এখন জেনে নিই কিভাবে প্রস্রাবে ফেনার সমস্যা এড়ানো যায়।

প্রস্রাবে ফেনা এড়ানোর প্রতিকার – ফেনাযুক্ত প্রস্রাব প্রতিরোধের টিপস

ফেনাযুক্ত প্রস্রাবের সমস্যা এড়াতে কিছু ব্যবস্থা কার্যকর প্রমাণিত হতে পারে । নিচে দেওয়া টিপসগুলো আপনাকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে সাহায্য করতে পারে –

  • বেশি বেশি করে পানি পান করুন
  • সবুজ শাক-সবজি ও মৌসুমি ফলমূল খান
  • সকালে বা সন্ধ্যায় কিছু সময় ব্যায়াম করুন
  • কখনই বেশীক্ষণ প্রস্রাব আটকে রাখবেন না
  • ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করুন

শেষ কথা

প্রস্রাবে ফেনা দেখা দিলে খুব বেশি আতঙ্কিত হবেন না, আবার একেবারে হালকাভাবেও নেবেন না । এটি মূলত কোনো রোগ নয়, তবে এটি অন্য কোনো রোগের লক্ষণ হতে পারে । তাই সময়মতো ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করানোই ভালো । আজকের আর্টিকেলে আমরা, ফেনাযুক্ত প্রস্রাবের কারণ, লক্ষণ এবং চিকিৎসা নিয়ে আপনাদের সাথে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি । আর্টিকেলটি নিয়ে যে কোন ধরনের প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে কমেন্ট সেকশনে জানান ।

Share on:
Avatar photo

Hello Friends, I am James harden, the founder of this site. This blog provides accurate and precise information on Technology, Banking, Insurance, Tips & Tricks, Online Earning, Computer troubleshooting and much more.

Leave a Comment