লাইফ ইন্সুরেন্স বা জীবন বীমা কেন করবেন ?

লাইফ ইন্সুরেন্স বা জীবন বীমা সম্পর্কে অনেকেই জানেন, আবার অনেকের মধ্যেই বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে । যারা লাইফ ইন্সুরেন্স সম্পর্কে জানেন তাদের মধ্যে হয়তো অনেকেই এর গুরুত্ব বোঝেন এবং নিজের বা পরিবারের জন্যে লাইফ ইন্সুরেন্স করে রাখেন। অনেকে মনে করেন, জীবন বীমা শুধুমাত্র বৃদ্ধ বয়সে কিছুটা সহায়তা পাবার জন্যে করা হয়। আবার অনেকের ধারনা, ১০ বা ২০ বছর পরে বীমার মেয়াদ পূর্ণ হলে যত অর্থ পাবেন, তা খুবই সামান্য। আসলে জীবন বীমা বিষয় টি নিয়ে আমাদের এই রকম ভাবার কারণ হল আমরা এই বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানি না অথবা অনেক ক্ষেত্রে জানার চেষ্টাও করি না । লাইফ ইন্সুরেন্স বা জীবন বীমার প্রায় এক ডজন বিষয় রয়েছে, যেগুলোর কারনে একজন মানুষের জীবন বীমা করা উচিত । তাহলে চলুন জেনে নেয়া যাক, লাইফ ইন্সুরেন্স বা জীবন বীমা কেন করবেন ?

লাইফ ইন্সুরেন্স বা জীবন বীমা কি?

লাইফ ইন্সুরেন্স  বা জীবন বীমা মুলত ইন্সুরেন্স সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এবং একজন ইন্সুরেন্স গ্রাহকের মধ্যে একটি আইন সন্মত চুক্তি বা এগ্রিমেন্ট, যা গ্রাহক এবং কোম্পানি উভয় পক্ষকেই লাভবান করে। এই চুক্তির মাধ্যমে ইন্সুরেন্স কোম্পানী লাভবান হয়, এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী গ্রাহকের থেকে প্রত্যেক মাসে অথবা প্রতি বছরে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অংকের টাকা পেয়ে। আর এই প্রাপ্ত অর্থ ইনস্যুরেন্স কোম্পানী তাদের বিভিন্ন ব্যবসায়িক কাজে লাগিয়ে আরো বৃদ্ধি করে তোলে।

অপরদিকে একজন ইন্সুরেন্স গ্রাহকের লাভ হচ্ছে, মৃত্যুর পর তার পরিবার বীমা সেবা প্রদানকারী কোম্পানির কাছ থেকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকেন। এর মাধ্যমে গ্রাহকের উত্তরাধিকারী, পরবর্তী জীবন চলার জন্য একটা আর্থিক নিশ্চয়তা পেয়ে থাকে। অনেক সময় গ্রাহক মৃত্যুর পূর্বেও বীমা কোম্পানীর থেকে আর্থিক ভাবে লাভবান হয়ে থাকেন। এটা সাধারনত ঘটে থাকে যখন বীমা গ্রাহক মারাত্মক রকমের অসুস্থ্য হন। তবে, এই বিষয়টি অবশ্যই চুক্তি পত্রে উল্লেখ করা থাকতে হবে।

বীমা কোম্পানী এবং বীমা গ্রাহকের মধ্যে গ্রহন করা এই চুক্তিকেই মুলত লাইফ ইন্সুরেন্স বা জীবন বীমা বলা হয়ে থাকে। এই ধরনের চুক্তি কোন একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তি অথবা একদল ব্যক্তির মাঝেও হতে পারে। অর্থাৎ, সিঙ্গেল ইন্সুরেন্স অথবা গ্রুপ ইন্সুরেন্স। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লাইফ ইন্সুরেন্স বা জীবন বীমা ইনকাম ট্যাক্স মুক্ত হয়ে থাকে। আমাদের দেশে প্রধান ২টি সরকারি ইন্সুরেন্স কোম্পানী (জীবন বীমা কর্পোরেশন এবং সাধারণ বীমা কর্পোরেশন) রয়েছে যাদের বেশিরভাগ স্কিমই সম্পূর্ণ ট্যাক্স মুক্ত।

লাইফ ইন্সুরেন্স বা জীবন বীমার ইতিহাস

১৯৭৩ সালে সাধারণ বীমা কর্পোরেশন এবং জীবন বীমা কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বীমা খাতের সূচনা হয় । উল্লেখ্য যে, ১৯৬০ সালের পহেলা মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পাকিস্তানের আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে যোগদান করেছিলেন। যার ফলে বর্তমানে বাংলাদেশে পহেলা মার্চ দিনটিকে বীমা দিবস হিসেবে পালন করা হয় ।

জীবন বীমা করার আগে যেসব বিষয় খেয়াল রাখতে হবে

লাইফ ইন্সুরেন্স বা জীবন বীমা করার পূর্বে আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখতে হবে –

  • যে কোম্পানির থেকে আপনি জীবন বীমা করাবেন, সেই কোম্পানির বিষয়ে খুব ভালোভাবে খোঁজ খবর নিন।
  • বীমা করার আগে সংশ্লিষ্ট বীমার শর্ত সমূহ খুব মনোযোগ সহকারে পড়ে (প্রয়োজনে একাধিক বার), দেখে, জেনে এবং বুঝে নিতে হবে।
  • প্রিমিয়াম জমা দেয়ার প্রসেস বা নিয়মাবলী এবং যদি কোন কারনে সময়সীমা অতিক্রম হয়ে যায় সেক্ষেত্রে কী করণীয় সেই বিষয়গুলো পরিষ্কার করে জেনে নিতে হবে।
  • বীমার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর ঠিক কত পরিমাণ টাকা পাওয়া যাবে এবং সেই প্রতিশ্রুত অর্থ কতদিনের মধ্যে পাওয়া যাবে, তা সঠিক ভাবে জেনে নিতে হবে।
  • মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর যথাসময়ে যদি প্রতিশ্রুত অর্থ না পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে গ্রাহক কী ধরনের আইনি সুরক্ষা পাবে সেটাও ভালোভাবে জেনে নিতে হবে।

লাইফ ইন্সুরেন্স বা জীবন বীমা কেন করবেন

পরিবারের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা

মানুষের জীবন বা মৃত্যু যাই বলুন না কেন, সব কিছুই মহান সৃষ্টিকর্তার হাতে। আমরা কেউই নিজেদের প্রিয়জনদের হারাতে না চাইলেও, এই নির্মম সত্যের সামনা সামনি আমাদের অনেককেই হতে হয়। এমনকি এটি আমার আপনার ক্ষেত্রেও ঘটা অস্বাভাবিক নয়। আর যদি এমন ঘটে তখন প্রিয়জনকে হারানোর শোকের ধাক্কার সাথে সাথে আর্থিক সংকটের মুখোমুখীও হতে হবে আমার বা আপনার পরিবারকে। ঠিক এই সময় একটি লাইফ ইন্সুরেন্স পলিসি আমার বা আপনার পরিবারের সদস্যদের প্রাথমিক ধাক্কাটি সামলে নেওয়ার সাহস জোগাতে পারে।

জীবন বীমার নিয়ম অনুযায়ী, বীমার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে যদি গ্রাহকের মৃত্যু হয়, তাহলে তার পরিবার বীমা পলিসির সপূর্ণ টাকা পেয়ে যাবেন। ধরে নেই, রহিম শেখ ২০ লাখ টাকা সমমূল্যের একটি জীবন বীমা করেছেন। কিন্তু হঠাৎ করেই বীমার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই তিনি মারা যান। সেক্ষেত্রে তার পরিবার বীমা কোম্পানির থেকে পুরো ২০ লাখ টাকাই পাবে, যা তাদের আর্থিক সংকট মকাবেলা করতে সহায়তা করবে।

চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহে সহযোগিতা

অনেক লাইফ ইন্সুরেন্স পলিসিতে কতগুলো রোগের চিকিৎসা ও দূর্ঘটনার বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করা থাকে। এমন পলিসির মাধ্যমে পলিসি গ্রাহক যদি দূর্ঘটনায় পড়ে অঙ্গ হারান সেক্ষেত্রে প্রযোজ্য আর্থিক সহায়তা পাবেন। রহিম শেখের কথাই ধরে নেয়া যাক। যদি তার করা পলিসিতে এই বিষয়টি উল্লেখ করা থাকে, তাহলে দূর্ঘটনার কবলে পরে হাতের কোনো একটি আঙ্গুল হারালে তিনি তার করা পলিসির মোট টাকার এক চতুর্থাংশ পাবেন। তার যেহেতু ২০ লাখ টাকার পলিসি সেই কারনে তিনি বীমা কোম্পানির থেকে ৫ লাখ টাকা পাবেন।

কিডনি নষ্ট হওয়া, হার্ট অ্যাটাকসহ আরও কিছু রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসা খরচ বাবদ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করে থাকে।

ঋণ পরিশোধে সহায়তা

বেশিভাগ মানুষই চায় না যে, তার নিজের মৃত্যুর পর, পরিবারের সদস্যরা তার করা ঋণের জালে জড়িয়ে যাক। সেই ঋণ হতে পারে বাড়ি তৈরি করার জন্য ঋণ, হতে পারে গাড়ি ক্রয়ের জন্য ঋণ, ক্রেডিট কার্ডে অথবা ব্যক্তিগত যে কোন ধরনের ঋণ। নির্ভরশীলতার জায়গাটি হারানোর কারনে এমনিতেই পরিবারের সদস্যরা অনেকটা অসহায় হয়ে পরে, তারওপর যদি বড় অংকের ঋণের চাপ থাকে সেক্ষেত্রে তারা পরপুরি ভাবে ভেঙ্গে পড়বে। জীবন বিমা পলিসির এই অর্থ ব্যবহার করে ঋণ পরিশোধের মাধ্যমে তারা ভারমুক্ত হতে পারে।

দীর্ঘ মেয়াদি লক্ষ্য অর্জনে

লাইফ ইন্সুরেন্স পলিসি দীর্ঘ মেয়াদী লক্ষ্য অর্জন করতে সহায়তা করে থাকে। ফ্ল্যাট বা বাড়ি ক্রয়ের ক্ষেত্রে, সন্তানের উচ্চতর শিক্ষা ইত্যাদি অনেক রকম বিষয়ে দারুণ সহায়তা পেতে পারেন আপনি।

বেসরকারি চাকরিজীবীদের অবসর পরবর্তী নিরাপত্তা

সরকারি চাকরিজীবীরা অবসর গ্রহনের পরে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা যেমন প্রভিডেন্ড ফান্ড, গ্রাচুইটি ইত্যাদির অনেক কিছুর পাশাপাশি পেনশনের সুবিধা পেয়ে থাকেন, যা তাদের অবসর পরবর্তী জীবনে আর্থিক ভাবে নিরাপত্তা প্রদান করে। কিন্তু অধিকাংশ বেসরকারি চাকরিজীবীরা এই ধরনের সুবিধা থেকে প্রায় সম্পূর্ণ রুপে বঞ্চিত। জীবন বীমা বা লাইফ ইন্সুরেন্সের মাধ্যমে আপনি আপনার অবসর পরবর্তী জীবনে আর্থিক ভাবে কিছুটা নিরাপত্তা পেতে পারেন।

কর সুবিধা

লাইফ ইন্সুরেন্সের ক্ষেত্রে কিছু কর সুবিধা পাওয়া যায়। প্রতি বছর জীবন বিমার প্রিমিয়াম হিসেবে যে টাকা জমা করা হয়, তা সম্পূর্ণ রূপে কর মুক্ত।

চাপে পড়ে সঞ্চয়

বেশিরভাগ সময় আমাদের সাধ আর সাধ্যের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই আমরা যতটুকুই উপার্জন করি না কেন, তা কোন না কোন ভাবে খরচ হয়ে যায়। প্রত্যেক দিনের পারিবারিক খরচ, সন্তানের শিক্ষার খরচ, বিয়ে জন্মদিনের মত সামাজিক অনুষ্ঠান, বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাওয়া, নতুন আসবাবপত্র বা ইলেকট্রনিক যে কোন কিছু কেনা- খরচের খাতের কোন অভাব নেই। এভাবে খরচ করতে করতে দেখা যায়, জমানোর খাতা একেবারেই শূন্য। কিন্তু একটি জীবন বীমা করা থাকলে সেটি সচল রাখার জন্য এক রকম বাধ্য হয়েই আপনাকে প্রিমিয়াম জমা দিতে হবে। আর এভাবেই অল্প অল্প করে কিছু সঞ্চয় হতে থাকবে, যা এক সময়ে বড় একটি অর্থে পরিণত হতে পারে।

নতুন পারিবারিক জীবন শুরু করার ক্ষেত্রে

আপনি যদি সদ্য পারিবারিক জীবন শুরু করে থাকেন, তবে আপনার যত দ্রুত সম্ভব জীবন বীমা করা প্রয়োজন। কারণ বেশি বয়সে জীবন বীমা করলে আপনি খুব বেশি লাভবান হতে পারবেন না। আপনার সন্তান হবে, সেই সাথে পরিবার বড় হবে এবং আপনার খরচ অনেক দিক থেকে বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং, বৃদ্ধ বয়সে যেন আপনাকে সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দুশ্চিন্তা করতে না হয়, সেজন্য একটি জিবন বীমা করে রাখতে পারেন। এতে করে শেষ বয়সে আপনাকে পরিবারের সদস্যদের জীবনযাপনের খরচ নিয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন।

শেষকথা

শেষপর্যায়ে জীবন বীমা বা লাইফ ইন্সুরেন্স সম্পর্কে আবারও কিছু সতর্কতা মুলক কথা বলতে চাই। জীবন বীমা বা লাইফ ইন্সুরেন্সের সুবিধার অভাব নেই এটা ঠিক। তবে ভুল কোম্পানিতে লাইফ ইন্সুরেন্স পলিসি খুললে অথবা প্রতারক কোন এজেন্টের কবলে পড়লে আপনার দুর্ভোগের কিন্তু শেষ থাকবে না। অনেক সময় পলিসি বাতিল করে দেয় অথবা হয়ে যায়, যার কারনে কাঙ্খিত সুবিধা বা অর্থ থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। তাই জীবন বীমা করার আগে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বিষয়ে ভালোভাবে খোঁজ খবর নিন, তাদের পূর্ববর্তি রেকর্ড চেক করে দেখুন। আর বিমা-চুক্তির শর্তগুলো খুব ভালো করে প্রয়োজনে একাধিকবার পড়ে এবং সম্পূর্ণ রুপে বুঝে নিতে হবে । বীমা চুক্তির সাথে সাথে প্রিমিয়াম জমা দেওয়ার রশিদ গুলো খুব সযত্নে সংগ্রহ করে রাখতে হবে।

বিডিটেকটিউনার

Share on:
Avatar photo

Hello Friends, I am James harden, the founder of this site. This blog provides accurate and precise information on Technology, Banking, Insurance, Tips & Tricks, Online Earning, Computer troubleshooting and much more.

Leave a Comment